আসাদুজ্জামান খান এমপি : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছিল; তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃতে ’৫২-এর অধিকারের আন্দোলন থেকে ’৬৬-এর স্বাধিকারের আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা ধাপে ধাপে আন্দোলন করে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও যখন পাকিস্তানিরা জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে তখনই বাঙালিদের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়।
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন যে, স্বাধীনতার বিকল্প আর কিছু নেই। তখনই চূড়ান্ত হয়ে যায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপথ। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পরিচালিত করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে।
নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১লা জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অজুহাত খুঁজতে থাকে সামরিক সরকার। এরই মধ্যে ১লা মার্চ, হঠাৎ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। স্ফূলিঙ্গের মতো আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঢাকায়।
উত্তাল মার্চে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ফার্মগেইট এলাকা।
বঙ্গবন্ধু আলোচনা চালিয়ে গেলেও জানতেন যে, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে হবে এবং সেজন্য তিনি আমাদের প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলতেন। তৎকালীন সময়ে ফার্মগেইট ছিল প্রতিবাদের মোক্ষম জায়গা। ফার্মগেইটে ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমরা ফার্মগেইট এলাকায় প্রতিদিন মিটিং-মিছিল করতাম। ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং আপামর জনতা আন্দোলনে যোগ দিত। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমরা নিজেদের প্রস্তুত রাখতে শুরু করি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশ গেইটের এক কিলোমিটারের মধ্যে ফার্মগেইট এলাকায় তখন প্রতিদিনই ব্যারিকেড দেয়া হতো। মিছিলে মিছিলে উত্তাল থাকতো রাজপথ।
আমাদের জমায়েত হওয়ার স্থান ছিল তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক ও হাবিব ব্যাংকের সামনে (এখনকার জনতা ব্যাংক ও কনকর্ড টাওয়ার)। স্বাধীনতার জন্য আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মধ্যেই দেখতাম উন্মাদনা। সবার দাবি ছিল একটাই; স্বাধীনতা। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের কাছে খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বের হতে পারে। কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা ২৫শে মার্চ ফার্মগেইটে একটি পরিখা খননের জন্য পরামর্শ দেন। পরিখা খনন অসম্ভব ছিল; কারণ ফার্মগেইটের পাশে আর্মিদের অবস্থান ছিল। পরিখার বদলে আমরা ফার্মগেইটে বড় করাত দিয়ে বড় দুটি কড়ই গাছ কেটে গাছের গুঁড়ি ও লোহালক্কড় দিয়ে ব্যারিকেড দেই। আমাদের সহযোগিতা করেন তৎকালীন তেজগাঁও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়াসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও আপামর জনসাধারণ। তেজগাঁও এলাকার শ্রমিকরাও এতে যোগ দেন।
২৫শে মার্চ দিনভর মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল ফার্মগেইট এলাকা। পরিখা খননের বদলে আমরা কড়ই গাছের গুঁড়ি, পুরনো গাড়ি, লোহার স্তূপ জমিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করি। রাত দশটার দিকে আস্তে আস্তে কমতে থাকে ফার্মগেইটের জনসমাগম। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি কতোটা ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। ভয়াল সেই কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করতেই অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সাঁজোয়া যান প্রস্তুত থাকে; যাদের গন্তব্য ছিল রাজারবাগ, ধানমণ্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিলখানা। আমরাও রাতে ফার্মগেইটের কৃষি বিভাগের বাগানের ভেতরে প্রস্তুত ছিলাম। আর অপেক্ষা করছিলাম কখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাঁজোয়া যান বের হবে। এই দিন দুপুরে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন তেজগাঁও থানার দুই পুলিশ সদস্য। তারা আমাদের কথামতো রাতে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকের ছাদে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে পজিশন নেন। সারাদিন মিছিল-মিটিংয়ের পর সন্ধ্যায় ফার্মগেইট এলাকায় জনসমাগম কমে আসে।
রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে থাকে ঘাতক সেনাদের কনভয়। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর কনভয় এগিয়ে আসতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেইটের সামনে এসে আমাদের বাধার মুখে এবং ব্যারিকেডের সম্মুখে এসে কনভয়ের গতি থেমে যায়। আমাদের কাছে যা ছিল তাই আমরা কনভয়ের উপর ছুড়ে ফেলতে থাকি এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত করি ফার্মগেইট এলাকা। তখন হাবিব ব্যাংকের উপর অবস্থান নেয়া দুই পুলিশ সদস্যও ফায়ার ওপেন করেন। কনভয় এসে রাস্তা পরিষ্কার করতে থাকে এবং আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; প্রথমে গুলি, পরে ব্রাশফায়ার করে। গুলির ফলে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে বাধ্য হই। আমরা যতক্ষণ ওখানে ছিলাম ততক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছিলাম এবং তারা মেশিনগানের গুলি দিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ফার্মগেইট এলাকায় প্রতিরোধের প্রথম ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাতকেরা। গোলাগুলির কারণে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে আত্মরক্ষা করি।
পাকিস্তানি ঘাতকেরা ফার্মগেইট এলাকায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে আরো সতর্ক হয়ে যায়। ফার্মগেইটের প্রতিরোধের ইতিহাস জানা যায় পাকিস্তানি ঘাতক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ঘনিষ্ঠ মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে। বইটির ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে ২৫শে মার্চ রাতে ফার্মগেইটে মুক্তিকামী বাঙালির প্রতিরোধের কথা। যার বাংলা সারমর্ম হলো, “ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া প্রথম সেনাদলটি বাধার মুখে পড়ে ফার্মগেইটে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে যার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। সদ্য কাটা বড় বড় গাছের গুঁড়ি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেল