হাসপাতালের কাপড় ধোয়া হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী ঢাকার মূল শহর থেকে অদূরেই কামরাঙ্গী চর থানা শহর। ঢাকার মতোই আধুনিক নগরায়নের পথে হাঁটছে এই শহরটি। খুব অল্প পরিসর নিয়ে গড়ে ওঠা এই শহরের চারপাশ দিয়েই বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদী। নদী বেষ্টিত এই চরটির সাথে বাইরের যোগাযোগ রক্ষার জন্য রয়েছে তিনটি পরিচিত ঘাট। লোহারপুল, কাঠেরপুল আর খোলামোড়া নামের এই ঘাটগুলো দিয়ে যারা নিয়মিত চলাচল করেন, তাদের চোখে দুইটি ব্যাপার অবশ্যই পড়বে। এক, এই ঘাট সংলগ্ন নদীর পানি অত্যন্ত নোংরা আর রোগ জীবাণুতে ভরা। দুই, এমন নোংরা-জীবাণুযুক্ত পানিতে সকাল থেকে শুরু করে পর্যন্ত বিকেল পর্যন্ত ধোপারা নানা কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করেন।
একটা সময় সাধারণত উচ্চ বর্ণ বা ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের পরিধেয় বস্ত্র বুড়িগঙ্গার পানিতে পরিষ্কার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন ধোপারা। সময়ের পরিক্রমায় দূষিত হয়েছে বুড়িগঙ্গা, এর পানি পরিণতি বিষাক্ত পানিতে। তবে এখনও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভেদে এখানে বিভিন্ন লন্ড্রি ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাপড় ধোয়া হয়। সব থেকে অবাক করা বিষয় হচ্ছে এমন নোংরা পানিতেও পরিষ্কার করা হচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন ব্যবহার করা কাপড়গুলোও! অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত চাদর, মাস্ক, পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, বালিশের কাভার, জানালা-দরজার পর্দা যাবতীয় কাপড় এই নোংরা পানিতে পরিষ্কার করা হয়।
জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল থেকে শুরু করে অভিজাত যত হাসপাতাল আছে সব হাসপাতালের কাপড়ই এখানে পরিষ্কার করেন তারা। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজগুলো অন্যদের বুঝিয়ে দিয়েই দায়িত্ব ছেড়ে দেয় হাসপাতালগুলো। কোন ধরণের নজরদারি নেই স্বাস্থ্য ঝুঁকির মতো এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এসবের বিষয়ে গুরুত্ব দেবার মতো কোন নির্দেশনাই নেই।
এ প্রসঙ্গে মিডফোর্ড হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা শাহীন শাহ বাপ্পির বলেন, এটি খুবই নতুন একটি বিষয়। হাসপাতালের দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য কাপড়গুলো যে, বুড়িগঙ্গার নোংরা পানিতে ধোয়া হয় সেটা আমরা শুনেছি কিন্তু কোনো দিন খতিয়ে দেখা হয়নি। আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি আমরা জানলাম এখন এই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, এই ধরনের কাপড় থেকে মূলত রোগীরা দুই জায়গায় জীবাণু আক্রমণের শিকার হতে পারে। প্রথমত রোগীদের থাকার বেড আর দ্বিতীয়ত অপারেশন থিয়েটার বা ওটিতে। তবে, অপারেশন থিয়েটারে এই ধরণের কাপড় থেকে রোগীরা রোগ জীবাণুতে আক্রান্ত হবে না। কারণ, অপারেশন থিয়েটারে যেসব কাপড় বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে জীবাণু মুক্ত করার জন্য ট্রেলাইজেশন করা হয়। অটোক্যাড নামে এক ধরণের যন্ত্রের মাধ্যমে এটা করা হয়।
ময়লা পানিতে কাপড় পরিষ্কার করলে যেভাবে জীবাণু ছড়াতে পারে তার বর্ণনা তুলে ধরে সানিয়া তহমিনা বলেন, যে কোন ব্যবহার্য্য কাপড় যদি নদীর পানিতে ধোয়া হয় তাহলে দুই ধরণের ইফেক্ট হতে পারে। একটা হলো কাপড় থেকে পানিতে জীবাণু যেতে পারে। এছাড়া কাপড় এবং পানি দুই স্তর থেকেই জীবাণু আক্রান্ত হতে পারে। প্রশ্রাব, পায়খানাসহ অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহার করা রক্তাক্ত কাপড় এবং কফ-থুতুসহ ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও কলেরার মতো রোগ জীবাণু পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। প্রশাব তো বটেই বিশেষ করে পায়খানার সাথে ইকোলাই নামে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর।
এছাড়া জ-িস আক্রান্ত রোগীর ভাইরাস থেকে পানি দূষিত হচ্ছে যার মাধ্যমে ওই পানি ব্যবহার করা মানুষ খুব দ্রুত নানা রোগে আক্রান্ত হবে। অন্য দিকে রক্ত বা পুঁজ থেকে এক ধরণের বিশেষ ব্যাকটেরিয়া পানিতে মিশে যাচ্ছে। ওই ব্যাকটেরিয়াযুক্ত পানি যদি কাটা-ছেঁড়া কোন মানুষের ক্ষতস্থানে প্রবেশ করে তাহলে ইনফেকশনের মাধ্যমে তার পঙ্গুত্ব বরণও করতে হতে পারে! শুধু ব্যাকটেরিয়াই নয় নদীতে থাকা বিভিন্ন টক্সিক এর কারণে এসব পানি খাওয়া বা অন্যান্য কাজে যারা ব্যবহার করেন তাদের ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, জ-িসসহ ইউরিন ইনফেকশনের মতো মারাত্মক রোগ হতে পারে। এসব পানিতে গোসলের সময় যদি পানি চোখে প্রবেশ করে তাহলে চোখে ইনফেকশন হতে পারে। আবার নিঃশ্বাসের সাথে এখানকার জীবাণু শরীরে ভেতরে প্রবেশ করে লাঞ্চের বিভিন্ন ধরণের সমস্যা যেমন, শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমার মতো জটিল রোগ হতে পারে। বিশেষ করে চর্ম রোগ হবেই।
দেখা যায়, অতিমাত্রায় ব্লিচিং পাউডার মেশানো নানা কাপড়ও ধোয়া হচ্ছে নদীর পানিতে। এতে করে তীব্র ও ঝাঁঝালো গন্ধে সেখানে অবস্থান করাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত্যন্ত ক্ষতিকারক কেমিকেল যুক্ত ব্লিচিং পাউডারের কারণে যেমন চার পাশের পরিবেশ হুমকির মুখে তেমনি নদীর পানি ও জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।