জোনায়েদ হোসেন ঃ আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তৃতীয় বর্ষ থেকে চাকরির বিষয়টা আমার মাথায় আসে। তখন আমার লক্ষ্য বিসিএস ক্যাডার হওয়া ছিল না (আসলে তেমন জানতাম না)। মানুষ বলতো পাওয়ারফুল লবিং ছাড়া ক্যাডার হওয়া যায় না। আমিও তা বিশ্বাস করতাম। সেজন্য প্রাইভেট কোন চাকরি বা ব্যাংক ই ছিল আমার টার্গেট।
প্রাইভেট চাকরির কথা চিন্তা করে আইবিএ থেকে এমবিএ বা সিএ করবো কিনা দেখছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে একবার কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় এসে আইবিএ (ঢাবি) এবং সিএ ভবন ঘুরে গেলাম। সিএ একটা দীর্ঘ মেয়াদী কোর্স। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আইবিএ এর জন্য ট্রাই করবো। তখনো আমি থার্ড ইয়ারে।
আইবিএ এর জন্য অনেকগুলো বই কিনলাম। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলোও পড়তেছিলাম। আমি গণিতের ছাত্র এবং সেকেন্ড ইয়ার থেকে ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট (ও লেভেল, এ লেভেল) পড়াতাম। তাই গণিত নিয়ে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ইংরেজিতে দুর্বলতা ছিল। তাই চট্টগ্রামে এক্সিকিউটিভ কেয়ার নামে একটা কোচিং সেন্টারে স্পোকেন ইংলিশ কোর্স এ ভর্তি হয়ে গেলাম। বেশ গুরুত্ব দিয়ে সবগুলো ক্লাসে এটেন্ড করলাম এবং ভালোই উন্নতি করলাম।
কর্মক্ষেত্রে ও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটারের গুরত্বের কথা চিন্তা করে ভাবলাম কম্পিউটারের উপর একটা ট্রেনিং করি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে একটা আইসিটি সেন্টার আছে। সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং টিকে গেলাম। বেশ গুরুত্ব দিয়ে ট্রেনিং করলাম এবং এটাতে আমি প্রথম হলাম।
এর পাশাপাশি পত্রিকা পড়া (একাধিক), প্রচুর বই পড়া ছিল আমার রুটিন কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটিতে এক মাসের একটা ডিবেট কর্মশালা করলাম (যা খুব কাজে লেগেছে পরে)।
ফোর্থ ইয়ারে উঠে আরো ভালোভাবে চিন্তা করা শুরু করলাম। কী করবো? দেশে থাকবো নাকি বিদেশ চলে যাবো? বহুবার ঢাকায় এসেছিলাম, ঘুরে ঘুরে দেখতাম কোথায় কী আছে। এর মধ্যে ৩৪তম বিসিএস এবং সোনালী ব্যাংকের একটা বড় সার্কুলার হলো। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার ডেটও দিল। অ্যাপেয়ার সার্টিফিকেট দিয়ে দুটিতেই আবেদন করলাম (তখন ব্যাংকেও করা যেতো)।
মাথায় চিন্তা ফোর্থ ইয়ার ফাইনালের জন্য পড়বো নাকি প্রিলি বা আইবিএ। সবকিছু সমন্বয় করে পড়ছিলাম। ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল শেষ করার পরই ৩৪ এর প্রিলি দিলাম। বিসিএস এর জন্য একটু সিরিয়াস হতে গিয়ে একাডেমিক পড়াশোনা কমিয়ে দিয়েছিলাম, সেজন্য থার্ড ইয়ার পর্যন্ত আমি থার্ড (তৃতীয়) ছিলাম কিন্তু ফাইনাল ইয়ারে অন্যরা বেশি পাওয়ায় পঞ্চম/ষষ্ঠ হই (অনার্স)।
৩৪তম, এর প্রিলি পাশ করে ফেললাম এবং প্রথম ১২ হাজারেই আমি ছিলাম (৩৪ এ দুইবার প্রিলির রেজাল্ট দেয়, প্রথমে ১২ হাজার, পরে একটা আন্দোলনের পর ৪৬ হাজার)। প্রিলি পাশ করার পর আইবিএ এর চিন্তা বাদ দিলাম। ভাবলাম আইবিএ থেকে পাশ করে বিসিএস দেয় ছেলেরা, আমি আর এই বাড়তি পরিশ্রম না করি। খুব ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করলাম। কিন্তু পরে যখন ৪৬ হাজার পাশ করানো হলো তখন কিছুটা উৎসাহ কমে গেল। মাস্টার্স আর রিটেনের প্রস্তুতি একসাথে নিতাম। এরপর ৩৪ লিখিত আর মাস্টার্স পরীক্ষা একসাথেই হয়েছে। মাস্টার্স এ সপ্তম হয়েছিলাম।
এরমধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রিলি, রিটেন পাশ করে ভাইভা দিলাম। ৩৪ এর রিটেন পাশ করে ভাইভাও দিলাম। বেকার জীবন শুরু (ছয় মাস)! কী করবো এ নিয়ে অনেক চিন্তা। শিক্ষক নিবন্ধন (কলেজ) দিলাম এবং পাশ করলাম। এরপর আইডিবির একটা আইটি ট্রেনিং(এক বছর মেয়াদী, ঢাকায়) বৃত্তির জন্য এপ্লাই করলাম। পরীক্ষা দিলাম, পাশও করলাম। কিন্তু ওরা শর্ত দিল সার্টিফিকেট জমা রাখতে হবে। তাই আর ভর্তি হইনি।
চট্টগ্রাম থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে এলাম। বিভিন্ন জায়গায় এপ্লাই করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি লিখিত পরীক্ষা দিতে গিয়ে বুঝলাম রাইটিং এ আরো ভালো করতে হবে। সাইফুরস কোচিং সেন্টারে রাইটিং কোর্স করলাম। তিন মাসের একটি কোর্স। আমার বিশ্বাস এটি আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এই সময়টা খুব কষ্টের ছিল। অর্থকষ্ট, চারদিকের চাপ আরো কত কী।
২০১৫ সালের জুনে সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে আমি চাকরিটা পেয়ে গেলাম। আমার প্রথম এপ্লাই-প্রথম ভাইভা! এখানে একটা কথা উল্লেখ করে নিই, আমার কোটা নেই। ঠিক একই সময়ে মাস্টারমাইন্ড থেকেও একটা অফার আসে! (সোনালী ব্যাংকে জয়েন করলাম)।
৩৪তম বিসিএস এর রেজাল্ট দিল ৩৫ তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার দুইদিন আগে, আমি নন ক্যাডার লিস্ট এ! মনে অনেক কষ্ট নিয়ে ৩৫ দিলাম। পরে ৩৪ এ নন ক্যাডার প্রথম শ্রেণীতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের গবেষণা কর্মকর্তা পদে চাকরি পেলাম। (জয়েন করিনি)
৩৫তম, বিসিএসএ ভাইভা খারাপ দিলাম। রেজাল্ট হলো, আমি তথ্য ক্যাডারে মেধা তালিকায় প্রথম হলাম। সোনালী ব্যাংক ছেড়ে তথ্য ক্যাডারে জয়েন করলাম। জয়েন করে মন আরো খারাপ হয়ে গেল। ক্যাডারগুলোর মধ্যে অনেক বৈষম্য! মেরিট লিস্টে আমার অনেক পিছনের কেউ অন্য ক্যাডারে আমার চেয়ে সুবিধা বেশি পাবে এটা মানতে পারিনি!
৩৬তম, ভাইভা দিতে গেলাম। ভাইভা নিলো ই না। বললো ক্যাডারতো আছো ই। মনে কষ্ট নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। কিন্তু রেজাল্ট দিলে দেখি ট্যাক্স ক্যাডারে আমি মেধা তালিকায় তৃতীয়! এখন আমি সহকারী কর কমিশনার হিসেবে এখানে কর্মরত আছি।
৩৭তম, দিয়েছিলাম পররাষ্ট্র ক্যাডারের জন্য (তখন পররাষ্ট্র ক্যাডারের জন্য আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল)। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হলাম।
এছাড়া আমি বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রাইভেট ব্যাংক ও আরো অনেক জায়গায় রিটেন পাশ করেছিলাম; ভাইভা দিই নি।
এই যে আমার ক্যারিয়ার প্ল্যান ও পরিশ্রম তা কিন্তু আমাকে ফল দিয়েছে। আমি গতানুগতিক কোন কোচিং করিনি। গুছিয়ে অনেক বই পড়েছি। বুঝে বুঝে পড়েছি যাতে প্রকৃত শিখা হয়।
আমার জীবনের গল্প যদি একজনের জীবনেও কাজে লাগে আমি খুশি হবো। জীবন একটাই, সাজিয়ে নিন।
(জোনায়েদ হোসেন
সহকারী কর কমিশনার)