নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক নারী কর্মকর্তা সম্প্রতি তার স্বামীর থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সংক্রান্ত আইনানুগ প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে তাদের বৈবাহিক কলহ চলে আসলেও চলতি লকডাউন পরিস্থিতিতে এটি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
ছোটখাট নানা বিষয়ে কটূক্তি থেকে শুরু, মিথ্যা অপবাদ এমনকি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী।
সেদিন রাতে সে হঠাৎ করে আমাকে মারতে শুরু করে। এতোটাই মারে যে আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এভাবেই স্বামীর নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।
এখন ও বাসায়, আমিও বাসায়। যেটা হয়, আমাকে নিয়ে যা-তা কথা বলে। আমি কেন বিকেলে ঘুমালাম, কেন রান্নাঘরে গেলাম না, কেন বাচ্চাকে পড়ালাম না, কেন কাজ শেষ করলাম না, এমন নানা ইস্যুতে নির্যাতন চলতেই থাকে। বাচ্চার কথা ভেবে এতোদিন সহ্য করেছি। এখন আর না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ডিভোর্স দিয়ে দেবো।
বাড়িতে একরকম গৃহবন্দি পরিস্থিতিতে যে শুধু নারীরাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তা নয়। পুরুষরাও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু তাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে বা এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে চাইছেন না।
বাংলাদেশে বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে পারিবারিক সহিংসতার চিত্র কেমন, সেটা নিয়ে কোন জরিপ করা হয়নি। তবে মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা জানিয়েছেন, লকডাউনের মধ্যে এই প্রবণতা স্বাভাবিকের চাইতে বেড়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী জানান গত কয়েক দিনে তাদের হেল্পলাইনে ঘরোয়া সহিংসতা সম্পর্কিত ফোন কলের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় জরুরি হেল্পলাইনেও সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়েছেন অনেকে।
অনেক নারী ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সেটা পারছেন না। নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা থাকলেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে নতুন করে কাউকে সেখানে যুক্ত করা হচ্ছে না।
নীনা গোস্বামী বলেন, বাস্তবিক যে চিত্র আমরা দেখতে পারছি সেটা বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে পারিবারিক সহিংসতার হার অন্যসময়ের চাইতে এখন অনেক বেশি।
বৈশ্বিক চিত্র প্রায় একই। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি বছর বিশ্বে অন্তত দেড় কোটি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইউএনএফপিএ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এমন অবস্থায় জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রতিটি দেশের জাতীয় পরিকল্পনায় পারিবারিক সহিংসতা রোধের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্রিটেনের জাতীয় হেল্পলাইনে গত দুইমাসে পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্ত কল এসেছে স্বাভাবিকের চাইতে প্রায় ৫০% বেশি। পারিবারিক কলহের জেরে দেশটিতে খুনের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে।
ফ্রান্সে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে ৩৬%, অস্ট্রেলিয়ায় ২০% শতাংশ। ভারতে দ্বিগুণ এবং তিউনিশিয়ায় বেড়েছে ৫ গুণ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, সিঙ্গাপুরের মতো কয়েকটি দেশে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
লকডাউন পরিস্থিতিতে মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ায় এই সহিংসতা ঘনীভূত হচ্ছে বলে জানান মনরোগবিদ মেখলা সরকার।
এর পেছনে বর্তমান পরিস্থিতিকে দায়ী করে মিসেস সরকার বলেন, মানুষ তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে, কতদিন এই লকডাউন চলবে তা নিয়ে, অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে সামাল দেবে এমন নানা বিষয়ে উদ্বেগে আছে। যার কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। মানুষ স্বভাবত কাছের মানুষের কাছেই তাদের রাগ প্রকাশ করে। মূলত এভাবেই বিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে।
পারিবারিক সহিংসতার শিকার বেশি হচ্ছেন নারীরা। উদ্বিগ্ন থাকা অবস্থায় মানুষের কাছে আরেক মানুষের নেতিবাচক দিকটাই বেশি নজরে আসে। আগে সেটা এড়িয়ে গেলেও লকডাউনে এক সাথে থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক সময় ঝগড়া বিবাদ হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াচ্ছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ভিন্নমতের বিভিন্ন মানুষ একই ছাদের নিচে বাস করে, সহিংসতা দেখা দেয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। এক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে কলহে না জড়িয়ে পাঁচটি উপায়ে এই কঠিন সময় মোকাবেলার পরামর্শ দিয়েছেন মিসেস সরকার।
তার পরামর্শ হলো- পরিবারের সদস্যদের সাথে কৌশলী হওয়া। তাদের প্রতি প্রত্যাশা কমিয়ে দেয়া। পরস্পরকে সহযোগিতা করা। তাদের কাজের প্রশংসা করা। অন্যের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য বা বিভেদের জায়গাগুলো মেনে নেয়া। ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ বাড়ানো।