রোগীর অভিযোগ বেডে লাশ পড়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা

জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ৯ জন করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাদের করতালি দিয়ে ব্যতিক্রমী বিদায় জানান হাসপাতালটির চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মকর্তা। সুস্থ হওয়া রোগীরা চলে যাওয়ার পর দুজন করোনা আক্রান্ত রোগী সাংবাদিকদের দেখে হাসপাতাল থেকে নিচে নেমে আসেন। অভিযোগ করেন, কেউ মারা গেলে দুই তিন ঘণ্টায়ও লাশ সরানো হয় না বেড থেকে। রোগীদেরও অবহেলা করা হয় বলে অভিযোগ তাদের। যদিও হাসপাতালটির চিকিৎসকরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদ্ধতি অনুসরণ করে মৃতদেহ সরানো হয়। অন্যদিকে করোনার চিকিৎসা প্রসঙ্গে ধারণা না থাকায় কোনও কোনও রোগী অভিযোগ করছেন।
শনিবার বেলা সোয়া ১২টার দিক থেকেই মুগদা জেনারেল হাসপাতালের গেটের সামনে জড়ো হন চিকিৎসকরা। তারা প্রস্তুতি নেন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা রোগীদের স্বাগত জানাতে। একটু ভিন্নভাবে বিদায় জানাতে। গেটের সামনে আসেন হাসপাতালটির অধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক শাহ গোলাম নবী, করোনার ফোকাল পারসন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানসহ অন্যান্য চিকিৎসক। সে সময়ই হাসপাতালের ওপর থেকে সাংবাদিকদের উদ্দেশে চিৎকার করতে থাকেন দু-তিনজন। তারা বলতে থাকেন, ‘তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না, অবহেলা করা হচ্ছে।’
৯ জন তখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন আনন্দিত হয়ে। অন্যদিকে তাদের চলে যাওয়ার পর দুজন ওপর থেকে নিচে নেমে আসেন। সাংবাদিকদের সামনে নানান অভিযোগ তুলে ধরেন।
অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন আহসানুল্লাহ ফরিদ। তিনি বলেন, ‘গত মঙ্গলবার আমার পাশের বেডে একজন মারা যান রাত ৯টার দিকে। আমরা অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করলাম, নার্সদের জানালাম একজন মারা গেছেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে দুজন আসলেন, তারা মরদেহ দূর থেকে দেখে চলে গেলেন। এরপর আর কোনও খবর নেই কারও। রাত বাড়ছে কেউ আসছে না। আমার বেডের পাশে লাশ পড়ে আছে, বোঝেন আমার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে। আমি যে খাবো, সেটাও পারছি না। লাশ পাশে রেখে কী খাওয়া সম্ভব। পরে রাত আড়াইটার দিকে লাশ সরানো হলো। এরপর আমি খেলাম।’
আহসানুল্লাহ ফরিদ বলেন, ‘কেউ মারা গেলে এমন ঘটনা ঘটে, তিন-চার ঘণ্টায়ও কেউ কেউ লাশ সরাতে আসেন না। শুক্রবার দিবাগত রাতে আমার পাশের ওয়ার্ডে একজন মারা যান। শনিবার সকাল ৯টার দিকে টয়লেটে যাওয়ার সময় দেখি সেখানে করিডোরে ট্রলিতে লাশ। সেই লাশ এখনও সরানো হয়নি। প্রতিবার টয়লেটে যাওয়ার সময় সবাইকে এই লাশের পাশ দিয়েই যেতে হচ্ছে।’
এই প্রতিবেদন লেখার সময় শনিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মরদেহটি সৎকারের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন আহসানুল্লাহ ফরিদ। অবহেলার অভিযোগ করে আহসানুল্লাহ ফরিদ বলেন, চিকিৎসক, নার্সরা ওয়ার্ডের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। পিপিই, মাস্ক পরার পরও তারা ভেতরে আসেন না। অথচ তারা তো ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে আরেকটু কাছে এসে আমাদের কথা শুনতে পারেন। দূর থেকে কী বলেন, না বলেন কিছুই পরিষ্কার বোঝা যায় না। তারাও আমাদের কথা ঠিকমতো বোঝেন কি না সন্দেহ আছে। নার্সরা ওষুধ রোগীদের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে যান। কারও অক্সিজেনের দরকার হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডেকেও কাউকে পাওয়া যায় না। অথচ এখানে সবারই মৃত্যু হচ্ছে শ্বাসকষ্টে। সময়মতো অক্সিজেন দেওয়া গেলে অনেককে হয়তো বাঁচানো যেতো।
এদিকে হাসপাতালের গেটে শামসুন্নাহার নামের এক নারী আহাজারি করতে থাকেন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে। তিনি বলেন, আমার ঠান্ডা লেগেছিল, আবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমার মনের সন্দেহ হওয়ায় পরীক্ষায় করেছি। পরের দিন আমাকে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে আমার করোনা হয়েছে। প্রথম পুলিশ আমাকে ফোন দিয়েছে। তারা (পুলিশ) বলল, আপনাকে ডাক্তারের নম্বর দিচ্ছি, তাদের ফোন দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে আমি ফোন দিলাম সকাল ৯টার দিকে, যে ফোন ধরলো সে বললো আপনি ১১টার দিকে ফোন দিয়ে আসেন। আমি ১১টার দিকে ফোন দিলাম। তখন বলল অন্য হাসপাতালে যান।
শামসুন্নাহার বলেন, আমি গরিব মানুষ। একটা রুমের মধ্যে ৫ জন মানুষ থাকি। আমি, আমার ছেলে, তার স্ত্রী আর এক নাতি ও নাতনি। নাতির বয়স ৫ বছর, আর নাতনির বয়স আড়াই বছর। আমরা ৫টা মানুষ যদি একটা বাসায় থাকি তাহলে কী হবে। যেহেতু করোনা ছোঁয়াচে রোগ। আমার স্বামী বেঁচে নেই। আমি তো কিছু চিনি না। আমি মুগদা হাসপাতাল চিনি, অন্য এলাকা তো না। এখন আমি কী করবো?
পরবর্তীতে শনিবার বিকালে সেই নারীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে অনেক অনুরোধ করেন তিনি। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শামসুন্নাহার বলেন, আমি ভর্তি হতে পেরেছি, কিন্তু এখানে অনেক ময়লা, পরিষ্কার করার কেউ নাই। আমি নিজে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেছি।
কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ডক্টর ফোরামের সভাপতি ও হাসপাতালটির চিকিৎসক অধ্যাপক মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘রোগীদের মধ্যে অনেকে প্রত্যাশা করেন তাদের গায়ে হাত দিয়ে, খুব কাছে গিয়ে ডাক্তাররা চিকিৎসা করবেন। কিন্তু করোনার মতো ছোঁয়াচে রোগের চিকিৎসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিদিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেগুলো মেনেই চিকিৎসা করতে হয়। করোনার কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। করোনা আক্রান্তদের ৮০ শতাংশের কোনও চিকিৎসা লাগে না। এখানে সাপোর্টিং চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেকেন্ডারি ইনফেকশন যাতে না হয় সেজন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। কখনও কখনও নিওমোনিয়া বেশি হলে অক্সিজেন, আইসিইউ সাপোর্ট লাগে, সেগুলো দেওয়া হয়। করোনার জন্য তো কোনও ওষুধ নেই, যেটি দিলে ভালো হয়ে যাবে। রোগীর যে লক্ষণ প্রকাশ পায় সে অনুযায়ী আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি।
মরদেহ সরানো প্রসঙ্গে অধ্যাপক মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘কেউ মারা গেলে আমাদেরকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ম মেনেই ডিসপোজাল করতে হয়। সৎকারের জন্যও নির্ধারিত নিয়ম আছে, সেগুলো অনুসরণ করতে হয়। নিদিষ্ট সময়, পদ্ধতি মেনেই সকল ব্যবস্থা করতে হয়। তবে আমরা দেখবো, যাতে ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের পাশে লাশ পড়ে না থাকে সেটির ব্যবস্থা করতে।
অধ্যাপক মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘শুরু দিকে যোগাযোগে কিছুটা সমস্যা ছিল। রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের যোগাযোগের সমস্যা দূর করতে আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ইন্টারকম টেলিফোন বসিয়েছি। যোগাযোগ আরও সহজ করতে আগামীতে রোগীদের ভর্তির সময় ইন্টারকমের নম্বরসহ বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে, যাতে এ নিয়ে সমস্যা না হয়। করোনার এই হাসপাতালগুলো কিন্তু বিশেষায়িত হাসপাতাল, এখানে কিন্তু ডাক্তার বারবার রোগীর কাছে যান না। ডাক্তাররা রাউন্ড দেন, দেখেন কোন রোগীর কী সমস্যা। সেই অনুপাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
হাসপাতালটির অধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক শাহ গোলাম নবী বলেন, ‘শুক্রবার আমাদের হাসপাতাল থেকে ১১জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। শনিবার মোট ৯ জন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। চিকিৎসা ঠিকমতো না হলে তো তারা সুস্থ হতেন না। আমাদের চেষ্টার কোনও কমতি নেই। হাসপাতালে এখন ভর্তি আছেন ২৮৯ জন। আমাদের সিট খালি না থাকলে তো নতুন করে কাউকে ভর্তি করা সম্ভব না। সেজন্য আমরা অন্য হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেই।


বিজ্ঞাপন