গতি হারিয়েছে বড় প্রকল্পগুলো

অর্থনীতি জাতীয়

করোনায় প্রতিরোধে প্রথম প্রকল্প শুরু

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করতে নির্বাচিত হাসপাতালে টেস্টিং সুবিধা বৃদ্ধি, করোনা চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয় এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণসহ নানা সুবিধা নিশ্চিত করতে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকার প্রথম প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপার্ডনেস’ বিষয়ক একটি প্রকল্পটি অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক সহজ শর্তের ঋণ থেকে ১০ কোটি ডলার বা প্রায় ৮৫০ কোটি খরচ করা হবে। বাকি টাকা ব্যয় হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এখন থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাই দেড় বছরে বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলতে ইআরডিকে সুপারিশ দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। সাধারণত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাসহ নানা প্রক্রিয়ার পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে যেহেতু জরুরি প্রয়োজনে প্রকল্পটি নেয়া হচ্ছে এবং একনেক বৈঠক বন্ধ রয়েছে তাই দ্রততার সঙ্গে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল।
প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কামাল আজাদ জানান, এর আগে এত দ্রুত কোনো প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ ও অনুমোদন হয়েছে কিনা সন্দেহ। কেননা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর মাত্র তিন দিনের মধ্যে পিইসি সভা এবং প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করে প্রক্রিয়াকরণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে এটি দ্রুত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রকল্পটি অফিস বন্ধ থাকলেও ই-মেইলের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কাগজপত্র আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমি সেগুলো দেখে একদিনের মধ্যেই পিইসি সভা করি। পরের দিন ডিপিপি রিকাস্ট (সংশোধন) হয়ে এলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয় অনুমোদনের জন্য।
জানা গেছে, করোনা প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে তহবিল ছাড় করার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ১০ কোটি ডলার অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ফাস্টট্র্যাক সহায়তা প্যাকেজ থেকে এই ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি মিয়াং টেম্বন বলেছিলেন, করোনার বিস্তার রোধে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক। ঋণের এ অর্থ করোনা প্রতিরোধে এ দেশের জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। ইতিমধ্যে ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ বিশ্বব্যাংকের এই জরুরি তহবিল থেকে অর্থ নিয়েছে। করোনা প্রতিরোধে প্রায় ১৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশেষ তহবিল গঠন করেছে বিশ্বব্যাংক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক উইংয়ের প্রধান শাহাবুদ্দিন পাটোয়ারী জানান, করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংকের কাছে ৮৫ কোটি ডালার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ মোকাবেলার জন্য ১০ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছর বাজেট সহায়তা হিসেবে ২৫ কোটি ডলার এবং আগামী অর্থবছরের বাজেট সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ইআরডি থেকে চিঠি দিয়ে এই সহায়তা চাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক ঘোষিত ফাস্টট্র্যাক সহায়তা প্যাকেজ থেকে ১০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
এদিকে, নতুন করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে বিশ্বজোড়া দুর্যোগের জেরে ধুঁকছে দেশের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতের ১০টি বড় ও আলোচিত প্রকল্প। ৫টির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, ৫টির কাজ ঝিমিয়ে পড়েছে। ফলে প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বড় প্রকল্পগুলো অনেকটাই বহুজাতিক। প্রকল্পের অর্থায়ন, বেশির ভাগ মালামাল, ঠিকাদার, পরামর্শক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলীরা বিদেশি। বিদেশিরা না থাকলে কাজ চলে না। আবার দেশীয় কর্মী ছাড়া বিদেশিরা বেকার। মালামাল না এলেও কাজ বন্ধ থাকে। করোনার কারণে বিদেশি কর্মী ও কর্মকর্তাদের একাংশ বাংলাদেশ ছেড়েছেন। অধিকাংশ দেশি কর্মী বাড়ি চলে গেছেন। মালামালে টান পড়েছে।
এই ১০টি বড় প্রকল্প সেতু, সড়ক, রেল আর বিদ্যুৎ খাতের। এগুলোর মোট ব্যয় ৩ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এমনিতেই নানা কারণে প্রায় সব প্রকল্পের কাজ পরিকল্পনা অনুসারে গতি পায়নি। ফলে সময় ও ব্যয় বেড়েছে। এখন নতুন যোগ হলো করোনা-অনিশ্চয়তা। ১০ প্রকল্পের ৩টি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের। এগুলো হচ্ছে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প। প্রথমটির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি দুটির কাজ কিছুটা কমে গেছে। এই তিন প্রকল্পের মোট ব্যয় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আরও তিনটি বড় প্রকল্প রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। এগুলো হচ্ছে—পদ্মা সেতুর দুই পারে রেললাইন নির্মাণ, চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন রেললাইন নির্মাণ এবং আখাউড়া-লাকসাম মিশ্রগেজ ডবল লাইন নির্মাণ। প্রথমটির কাজ সীমিতভাবে চলছে, বাকি দুটি বন্ধ হয়ে গেছে। এই তিন প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চীনা কর্মী ও প্রকৌশলীদের বড় অংশই বাংলাদেশে আছেন। চীন থেকে এখন মালামালও আসছে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়াসহ অন্য বিদেশিদের অনেকেই চলে গেছেন। অনেক দেশ থেকে মালামাল আসছে না। ফলে আটকে গেছে কাজ।
১০ বড় প্রকল্পের বাকি চারটি বিদ্যুৎ খাতের। এগুলো হচ্ছে—পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক এবং রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প। প্রথম দুটির কাজ বন্ধ আছে। চার প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যার দুই-তৃতীয়াংশ রূপপুরের জন্য।
মাতারবাড়ী ও রূপপুরে বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ বন্ধ রাখার দাবি তুলেছেন। প্রকল্প দুটির কর্তৃপক্ষ এখনো সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাঁর মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এ সময় শ্রমিকেরা বেতন পাবেন, কারও চাকরি যাবে না।
বড় প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে কাজ করেন সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তাঁর মতে, প্রকল্প ঝুলে গিয়ে ব্যয় বাড়ার বিদ্যমান প্রবণতাটি করোনা পরিস্থিতিতে আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, অর্থনীতির ওপর চাপ কমাতে হলে কাজগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করার উপায় ভাবতেই হবে। শ্রমিকদের নির্দিষ্ট এলাকায় রেখে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়ে হলেও কাজ শুরু করতে হবে।
শ্রমিকদের দাবি অগ্রাহ্য করে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রটির দায়িত্বে আছে সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। সেখানে এখন প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকাটি লকডাউনের দাবিতে ৯ ও ১০ এপ্রিল শ্রমিকদের একাংশ কাজ বন্ধ রেখেছিল। তবে সিপিজিসিবিএল এ দাবিকে পাত্তা দেয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ধর্মঘটে যাওয়া শ্রমিকেরা আরও বলেছিলেন, লকডাউন অবস্থায় প্রত্যেককে তিন মাস বেতন দিতে হবে এবং কাউকে ছাঁটাই করা যাবে না।
সিপিজিসিবিএলের নির্বাহী পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ নেই। মাতারবাড়ীতে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা কাজ হচ্ছে। কাজ চলবে।’ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা হবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে চলা প্রকল্পটিতে একটি বন্দর নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পের শুরু ২০১৪ সালে। নির্মাণকাজের ঠিকাদার নিয়োগ হয় ২০১৭ সাল। ২০২৪ সালে কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা।
পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য রুশ ফেডারেশনের সরকারি সংস্থা রাশিয়ান স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের (রোসাটম) সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রটি নির্মাণের ঠিকাদার হচ্ছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। রোসাটম ১২ এপ্রিল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়া কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছে, করোনাকালেও প্রকল্পের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে।
তবে গত ২৬ মার্চ প্রকল্পের একজন বেলারুশি কর্মকর্তার জ্বর ও গলাব্যথা হলে, ঈশ্বরদী সদরে তিনিসহ বিদেশি কর্মকর্তাদের ভাড়া বাড়িটি স্থানীয় প্রশাসন লকডাউন করে দেয়। এক দিন পরেই অবশ্য রোসাটমের দক্ষিণ এশিয়া কার্যালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, ওই কর্মকর্তার নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়নি। দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ সালে। শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে।
করোনা পরিস্থিতিতে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। এখানে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। প্রথম কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি গত বছরে উৎপাদনে গেছে। দ্বিতীয় ইউনিট আর দ্বিতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রর নির্মাণকাজ চলছে। বাগেরহাট জেলার রামপালে সুন্দরবনের কাছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। পরে সেটা গিয়ে ঠেকে ২০১৯ সালে। নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। করোনাভাইরাস কাজ বন্ধ করে দিল।
করোনাকালে পদ্মা সেতুর দুটি স্টিলের কাঠামো (স্প্যান) খুঁটিতে বসানো হয়েছে। কাজ এখনো চলছে। তবে প্রকল্পের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে ৪০ শতাংশ কাজ কমে গেছে। চলতি মাসে কাজ আরও কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, করোনার প্রকোপ চলতে থাকলে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে। গত মার্চ পর্যন্ত সার্বিক কাজের ৭৮ শতাংশ আর মূল সেতুর কাজের ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে চার হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মী কাজ করেন। কর্মকর্তাদের হিসাবে, তাঁদের হাজার দেড়েক ছুটিতে চলে গেছেন। কেউ কেউ ফিরছেন। তবে কাজে যোগ দেওয়ার আগে তাঁদের ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিন পালন করতে হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষই চাইছে না যে বাংলাদেশি কর্মীরা এখনই কাজে ফিরুন। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সবাইকে প্রকল্প এলাকার দুই প্রান্তে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় রাখা হচ্ছে। তাঁদের সে জায়গা থেকে বেরোতে দেওয়া হয় না। বেশি কর্মী রাখার ব্যবস্থা করা কঠিন হবে। প্রকল্পে চীনের হাজারখানেক কর্মী কাজ করেন। তাঁদের ১০০ জনের মতো বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন, এখনো ফেরেননি। কর্মকর্তারা কাজ চালু রাখার আরও কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছেন। সেগুলো হচ্ছে: সিমেন্টের সরবরাহ থাকা; চীন থেকে মালামাল সময়মতো পৌঁছানো এবং বিদেশি পরামর্শকদের ধরে রাখা।
পদ্মা সেতুর সিমেন্ট আসে নারায়ণগঞ্জের কারখানাগুলো থেকে। সেখানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলছে। এ ছাড়া কাঁচামাল ক্লিংকারের সংকট রয়েছে। ফলে সিমেন্টের পর্যাপ্ত ও নিয়মিত জোগান ঝুঁকিতে পড়তে পারে। পদ্মা সেতুতে ৪১টি স্টিলের স্প্যান বসাতে হবে। এযাবৎ বসানো হয়েছে ২৮টি। কথা ছিল, জুলাইয়ের মধ্যে সব কটি বসানো হয়ে যাবে। কর্মকর্তারা বলছেন, তা সম্ভব না হলে ঘোষণামতো আগামী বছরের জুনে সেতুটি চালু করা না-ও যেতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২০০ জনের বেশি বিদেশি পরামর্শক কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ, জাপান, কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক রয়েছেন। ইতিমধ্যে ২৫ জনের মতো বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ জানিয়ে দিয়েছেন, আর ফিরবেন না। কয়েক দফা পিছিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালে। সেটা পিছিয়ে প্রথমে ২০১৯, পরে আগামী বছরের জুনে গিয়ে ঠেকে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গপথ বা টানেল তৈরি হচ্ছে চীনা অর্থায়নে। ঠিকাদারও চীনের। টানেলের ভেতরে প্রতিদিন ৮ মিটার করে রিং বা পাত নির্মাণের কাজ চলছে। এখন আর রাতে কাজ হচ্ছে না। এ ছাড়া বাইরে সড়কের কাজ বন্ধ আছে। এখন কাজ করছেন ২০০ জনের বেশি চীনা নাগরিক। বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই চীনের। প্রকল্পের শীর্ষ একটি সূত্র বলছে, টানেলের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হবে না। চীনা নাগরিকদের বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে দেশীয় কর্মী পাওয়া না গেলে কাজে গতি আসবে না। এ ছাড়া চীন থেকে নিরবচ্ছিন্ন মালামালও আসতে হবে। চীন ও বাংলাদেশ সরকারের (জি-টু-জি) যৌথ উদ্যোগের এই প্রকল্পের ঠিকাদার চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। এর ৫১ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। নদীর তলদেশের নিচে ৩.৪ কিলোমিটার টানেল, দুই মুখে সড়ক আর ওভারপাস বা সেতুসড়ক নির্মিত হচ্ছে। ২০১৫ সালের প্রকল্পে পরের বছরই ঠিকাদার নিয়োগ হয়। কিন্তু চীনা সরকার সময়মতো অর্থ ছাড় না করায় কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আগামী বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল চালু করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। কিন্তু করোনাকালে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই প্রকল্পের ৪১ শতাংশ কাজ হয়েছিল। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে ২০ কিলোমিটার। আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ আগে শেষ হওয়ার কথা। সেই কাজ প্রায় ৭০ ভাগ এগিয়েছে। এযাবৎ প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উড়ালপথ নির্মাণ হয়েছে। রেললাইন বসানো শুরু হয়েছিল।
প্রকল্পের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, দুই কারণে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথমত, দেশীয় সব কর্মী বাড়ি চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত, বিদেশ থেকে মালামাল আসছে না। ইতালি থেকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের চালান বাক্সবন্দী হয়েও জাহাজে উঠতে পারেনি। একইভাবে ভারত, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের মালামাল আসছে না। এমনকি কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কর্মকর্তারা আশা করছেন, চীনের কারখানাগুলো চালু হয়েছে, সেখান থেকে মালামাল আসবে। সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প অনুমোদন করে ২০১২ সালে। পরের বছর জাইকার সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। গত বছরই একাংশ চালু হওয়ার কথা ছিল। দুই বছর পিছিয়েছে।
রেলের তিন বড় প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণের কাজ কোনোরকমে চলছে। বাকি দুটি অপেক্ষাকৃত কম বাজেটের প্রকল্পের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। রেলের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলেছে, দেশীয় কোনো কর্মীকেই পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশি প্রকৌশলী ও কর্মীদেরও অনেকে দেশ ছেড়েছেন।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের প্রকল্পটি চলছে চীনের অর্থায়নে, জি-টু-জি পদ্ধতিতে। ঠিকাদারও চীনা কোম্পানি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ। প্রকল্পটির ঋণচুক্তি হয়েছিল ২০১৬ সালে। তবে কাজ শুরু হয়েছে গত বছর। তারপরই শুরু হয়ে গেল করোনাকাল। এখন চীনা কিছু নাগরিক কাজ করছেন, স্থানীয় কোনো কর্মী নেই। এক-চতুর্থাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত সরাসরি রেলপথ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশ কাজও হয়নি। চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজটির ঠিকাদার ম্যাক্স ও তমা। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, এখানে ৫০০-এর বেশি দক্ষ কর্মীসহ মোট ১ হাজার ২০০ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করতেন। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁরা বাড়ি চলে গেছেন। ৬০-৭০ জন চীনা নাগরিক আছেন, কিন্তু তাঁরা কাজ করতে পারছেন না।
আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত মিশ্রগেজের ডবল লাইন নির্মাণের প্রকল্পটির কাজ শেষ পর্যায়ে এসে করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। চলতি বছরই এই রেলপথ চালু করার কথা ছিল। রেলের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেন, দুর্যোগের ওপর তো কারও হাত নেই। তবু পদ্মা সেতুর রেল যোগাযোগ প্রকল্পের কাজ কিছুটা চলছে। মো. বেলায়েত হোসেন সড়ক, জনপথ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব। তিনি অবশ্য বললেন, তাঁদের পদ্মা সেতু আর কর্ণফুলী টানেলের কাজ বন্ধ হয়নি। তবে সব কাজেরই গতি কিছুটা কমেছে।


বিজ্ঞাপন