ভাঙল সব রেকর্ড

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

দেশে আক্রান্ত ১,১৬২
মোট মৃত্যু ২৬৯

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : মহামারী করোনা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে গোটা পৃথিবীকে। সেই তালিকায় বাদ যায় নি বাংলাদেশও। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা। সেই সঙ্গে দেশে বাড়ানো হচ্ছে নমুনা সংগ্রহ ও নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও। দেশে করোনা সংক্রমণের পর বুধবার নমুনা পরীক্ষা, আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে আগের সব রেকর্ড।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১ হাজার ১৬২ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। যা এ যাবত-কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর এ সময়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯ জন। এটিও একদিনে দেশে প্রাণহানির দিক থেকে সবচেয়ে বেশি।
এ নিয়ে বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ১৭,৮২২ জন। আর এখন পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ২৬৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েছেন ২১৪ জন। ফলে এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৩,৩৬১ জন।
বাংলাদেশ সরকার করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দিনে ১০,০০০ নমুনা পরীক্ষার টার্গেট করা হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, গেল ২৪ ঘণ্টায় সব সংখ্যাই বেড়েছে। নমুনা পরীক্ষার ল্যাবের সংখ্যার পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা, শনাক্তকৃত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় দেশে মারা গেছেন ১৯ জন।
তিনি ৪১টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার তথ্য তুলে ধরে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস শনাক্তে আরও সাত হাজার ৮৬২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় আগের কিছু মিলিয়ে সাত হাজার ৯০০টি। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো এক লাখ ৪৪ হাজার ৫৩৮টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় আরও এক হাজার ১৬২ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, যা এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শনাক্তের রেকর্ড। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮২২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন আরও ১৯ জন, এটিও রেকর্ড। ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৬৯-এ। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ২১৪ জন। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিন হাজার ৩৬১ জন।
বুলেটিনে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ-নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হলেও তা মূলত প্রকাশ্যে আসে জানুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারিতে চীনে যখন এটি ভয়াবহ রূপ নেয় তখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। সবাই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও বিদেশ ফেরতদের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিংসহ নানা পদক্ষেপ নেয়।
তবে এতকিছুর পরও ৮ মার্চ দেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকে এর প্রাদুর্ভাব। এপ্রিলে এসে ভাইরাসটি যেন মারাত্মক রূপ ধারণ করে। যার ফলশ্রুতিতে মৃতের সংখ্যা পেরিয়ে যায় দুই’শ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন এর করাল গ্রাসে দিশেহারা তখন অনেকটাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল চীন। অনেকদিন ধরে সেখানে মৃত্যুর তথ্যও পাওয়া যায়নি। এছাড়া ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহানে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি অনেকদিন। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে আবার নতুন করে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এরপর লকডাউন করা হয়েছে একটি শহর।
এছাড়া উহান শহরের বাসিন্দাদের আগামী ১০ দিনের মধ্যেই করোনা টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া ভাইরাস দমনে অনেকটাই সফল জার্মানি লকডাউন শিথিল করে বিপাকে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত লকডাউন শিথিল করার পর থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। এরপর থেকে বারবার ঘুরে ঘুরে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী সামনে আসছে।
তারা বলেছিলেন, ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক যতদিন বাজারে না আসবে, ততদিন লকডাউনই একমাত্র ভরসা।
এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এ ভাইরাসটিতে সংক্রণের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে ৪৩ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৭ জনের শরীরে। এছাড়া এতে মারা গেছেন ২ লাখ ৯২ হাজার ৮৯৯ জন। ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছেন ১৬ লাখ ২ হাজার ৭১২ জন।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সারাদেশে চলছে ছুটি। বন্ধ বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহন। যদিও এপ্রিলের শেষ এবং মে মাসের শুরুর দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত ১০ মে থেকে শর্তসাপেক্ষে খুলে দেয়া হয়েছে দোকানপাট ও শপিংমলও।
তিন লাখ ছুঁই ছুঁই মৃতের সংখ্যা : বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বাড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস। প্রায় প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। আবার আক্রান্তের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
গতবছরে শেষের দিকে চীনে উহান হুবেই প্রদেশের প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। গত এপ্রিলে এসে ভয়াবহ রূপ নেয় করোনা। মে মাসে একটু কমলেও প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন।
বিশ্বে ভয়াল করোনায় মৃতের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ছুঁই ছুঁই। এছাড়া এই ভাইরাস ৪৩ লাখেরও বেশি মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৮৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। সেখানে আক্রান্ত ১৪ লাখ।
এছাড়া মৃত্যুতে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৪০ হাজার ৪৯৬, ইতালিতে ৩০ হাজার ৭৩৯, স্পেনে ২৬ হাজার ৭৪৪, ফ্রান্সে ২৬ হাজার ৬৪৩, ব্রাজিলে ১১ হাজার ৬২৫, বেলজিয়ামে ৮ হাজার ৮০৭, জার্মানিতে ৭ হাজার ৬৬১, ইরানে ৬ হাজার ৬৮৫, নেদারল্যান্ডস ৫ হাজার ৪৫৬ ও কানাডায় মারা গেছে ৪ হাজার ৯৯৩ জন।
তবে লাখো মৃত্যুর খবরের মধ্যে স্বস্তির খবর এটাই যে, কোভিড-১৯ রোগে শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শেষে ইতোমধ্যে ১৫ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ এখন সুস্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ১০৮টি সম্ভ্যাব্য ভ্যাকসিনের কাজ চলছে। এরমধ্যে আটটি ভ্যাকসিন প্রথম ধাপ অর্থাৎ মানবদেহে প্রয়োগ সম্পন্ন করেছে।
এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা দিলেও করোনাভাইরাস তার আগ্রাসী রুপ দেখাতে শুরু করেছে এশিয়ায়। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছে তেইশ শত মানুষ। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোতে।
শুধু ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নয় আক্রান্ত বেড়েছে করোনা প্রতিরোধে সফল মনে করা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুরেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, করোনার নতুন কেন্দ্র হতে পারে এশিয়া। এই অঞ্চলের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে প্রাণ হারাতে পারেন লাখ লাখ মানুষ।
মাহামরি নভেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহানে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাস। উহানে আবার করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ায় নতুন করে সেখানে তা বিস্তার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর তাই আগামী ১০ দিনের মধ্যে সব বাসিন্দাদের করোনা পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছে চীন সরকার।
মহামারীর কারণে বিশ্ব বাজার ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু কিছুটা কমতে শুরু করায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও লকডাউন শিথিল হতে শুরু করেছে। সরকারগুলো ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।


বিজ্ঞাপন