নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে তাজউদ্দীন আহমদ যে যাত্রা সূচনা করেছিলেন সেই পথ ধরে বাংলাদেশের ৪৯তম বাজেট পেশ করলেন আহম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল, যার আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা মতো। তা পাস হবে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।
কোভিড-১৯ মহামারির উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে এবার একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন। বুধবার শুরু হবে বাজেট অধিবেশন। এবার বাজেট অধিবেশন হবে খুবই সংক্ষিপ্ত। ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে সব সংসদ সদস্যও এতে অংশ নেবেন না।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক থেকে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন সরকারে ১২ জন অর্থমন্ত্রী (অর্থ উপদেষ্টা অথবা সামরিক আইন প্রশাসক) ৪৭টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন এর আগে। মুস্তফা কামাল গত বছরের ১৩ জুন তার প্রথম বাজেট (২০১৯-২০ অর্থবছর) উপস্থাপন করেছিলেন। বৃহস্পতিবার উপস্থাপন করেন দ্বিতীয় বাজেট। আর আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর চলতি মেয়াদের দ্বিতীয় ও টানা ১২তম বাজেট। আর বাংলাদেশের ৪৯তম বাজেট।
বাজেট আসলেই দেশের মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। জুন মাসের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। বাজেটে নতুন কী থাকছে, কিসের দাম বাড়ছে, কিসের দাম কমছে সেদিকে থাকে সাধারণ মানুষের মূল আগ্রহ।
বাজেট অংকের হিসাবে যতোটা না মনোযোগ পায় তার চেয়ে বেশি মনোযোগ থাকে বাজার দরের ওপর। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক মোক্ষম সময় প্রতিপক্ষকে আক্রমণের। সরকারি দল বলে উন্নয়নের বাজেট, বিরোধী দল বলে গরিব মারার বাজেট। জাতীয় বাজেট হচ্ছে সরকার প্রণীত একটি রাষ্ট্রের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনার দলিল।
‘বাজেট’শব্দটির উৎপত্তি
ফরাসি শব্দ বোওগেট থেকে। যার অর্থ চামড়ার ব্যাগ, বা ইংরেজীতে ইধম। অতীতে থলেতে ভ’রে এটি আইন সভা বা সংসদে আনা হতো বলে এই দলিলটি ‘বাজেট’ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। বাজেট পদ্ধতি গ্রিকদের সময়ে আবিষ্কৃত হলেও প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায় ব্রিটেনে।
দু’টি মূল অংশ নিয়ে জাতীয় বাজেট গঠিত। প্রথম অংশ রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত। এই অংশে সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থা ও আদায় সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাবনা বিদ্যমান। অপরদিকে দ্বিতীয় অংশে থাকে সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাবসমূহ।
প্রতি বৎসর বাজেট একটি আইনপ্রস্তাব বা ‘বিল’আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। সংসদ সদস্যদের অনুমোদন শেষে এটি আইনে পরিণত হয়। বাংলাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব প্রস্তাবনা প্রণয়ন করে এবং অর্থ বিভাগ ব্যয় প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে।
প্রতি বছর জুনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল পেশ করেন। এর আগে এই বাজেট বিল ক্যাবিনেট সভায় বিবেচনা ও অনুমোদন করা হয়। অনুমোদনের পর জুলাই থেকে পরবর্তী ১২ মাসের জন্য কার্যকরী হয় হয়। বাংলাদেশে অর্থবছর শুরু হয় জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেন তখনকার সময়ের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। ৩০ জুন ১৯৭২ সালে তিনি প্রথম বাজেট পেশ করেন। বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ বার করে বাজেট পেশ করেন সিলেটের দুই সন্তান প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তবে টানা দশবার বাজেট দিয়ে রেকর্ড গড়েছেন মুহিত। সিলেটের এই সন্তান শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। এর আগে তিনি এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-১৪ এই দুই অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন।
বাজেট যে শুধু অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসেবে তিনটি বাজেট উপস্থাপন করেন। বিকালে দেশের ইতিহাসের ৪৯তম বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন মুস্তফা কামাল।
স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত ঘোষিত বাজেটের আকার, এডিপির পরিমাণ এবং বাজেট প্রস্তাবকের নাম তুলে ধরা হলো।
১৯৭২-৭৩: বাজেট প্রস্তাবক- তাজউদ্দীন আহমেদ। বাজেটের আকার-৭৮৬ কোটি টাকা। এডিপি- ৫০১ কোটি টাকা।
১৯৭৩-৭৪: বাজেট প্রস্তাবক- তাজউদ্দীন আহমেদ। বাজেটের আকার- ৯৯৫ কোটি টাকা।এডিপি- ৫২৫ কোটি টাকা।
১৯৭৪-৭৫: বাজেট প্রস্তাবক- তাজউদ্দীন আহমেদ। বাজেটের আকার- ১,০৮৪ কোটি টাকা। এডিপি- ৫২৫ কোটি টাকা।
১৯৭৫-৭৬: বাজেট প্রস্তাবক- ড. আজিজুর রহমান। বাজেটের আকার- ১,৫৪৯ কোটি টাকা। এডিপি- ৯৫০ কোটি টাকা।
১৯৭৬-৭৭: বাজেট প্রস্তাবক- মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বাজেটের আকার- ১৯৮৯ কোটি টাকা। এডিপি- ১,২২২ কোটি টাকা।
১৯৭৭-৭৮: বাজেট প্রস্তাবক- মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বাজেটের আকার- ২,১৮৪ কোটি টাকা। এডিপি- ১,২৭৮ কোটি টাকা।
১৯৭৮-৭৯: বাজেট প্রস্তাবক- প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাজেটের আকার- ২,৪৯৯ কোটি টাকা। এডিপি- ১,৪৪৬ কোটি টাকা।
১৯৭৯-৮০: বাজেট প্রস্তাবক- ড. এম এন হুদা। বাজেটের আকার- ৩,৩১৭ কোটি টাকা। এডিপি- ২,১২৩ কোটি টাকা।
১৯৮০-৮১: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৪,১০৮ কোটি টাকা, এডিপি- ২,৭০০ কোটি টাকা।
১৯৮১-৮২: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৪,৬৭৭ কোটি টাকা। এডিপি- ৩,০১৫ কোটি টাকা।
১৯৮২-৮৩: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ৪,৭৩৮ কোটি টাকা। এডিপি- ২,৭০০ কোটি টাকা।
১৯৮৩-৮৪: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ৫,৮৯৬ কোটি টাকা। এডিপি- ৩,৪৮৩ কোটি টাকা।
১৯৮৪-৮৫: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইদুজ্জামান। বাজেটের আকার- ৬,৬৯৯ কোটি টাকা। এডিপি- ৩,৮৯৬ কোটি টাকা।
১৯৮৫-৮৬: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইদুজ্জামান। বাজেটের আকার- ৭,১৩৮ কোটি টাকা। এডিপি- ৩,৮২৫ কোটি টাকা।
১৯৮৬-৮৭: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইদুজ্জামান। বাজেটের আকার- ৮,৫০৪ কোটি টাকা। এডিপি- ৪,৭৬৪ কোটি টাকা।
১৯৮৭-৮৮: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইদুজ্জামান। বাজেটের আকার- ৮,৫২৭ কোটি টাকা। এডিপি- ৫,০৪৬ কোটি টাকা।
১৯৮৮-৮৯: বাজেট প্রস্তাবক- মেজর জেনারেল মুনিম। বাজেটের আকার- ১০,৫৬৫ কোটি টাকা। এডিপি- ৫,৩১৫ কোটি টাকা।
১৯৮৯-৯০: বাজেট প্রস্তাবক- ড. ওয়াহিদুল হক। বাজেটের আকার- ১২,৭০৩ কোটি টাকা। এডিপি- ৫,৮০৩ কোটি টাকা।
১৯৯০-৯১: বাজেট প্রস্তাবক- মেজর জেনারেল মুনিম। বাজেটের আকার- ১২,৯৬০ কোটি টাকা।এডিপি ৫,৬৬৮ কোটি টাকা।
১৯৯১-৯২: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান।বাজেটের আকার- ১৫,৫৮৪ কোটি টাকা। এডিপি- ৭,৫০০ কোটি টাকা।
১৯৯২-৯৩: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ১৭,৬০৭ কোটি টাকা। এডিপি- ৯,০৫৭ কোটি টাকা।
১৯৯৩-৯৪: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান।বাজেটের আকার- ১৯,০৫০ কোটি টাকা। এডিপি- ৯,৭৫০ কোটি টাকা।
১৯৯৪-৯৫: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান।বাজেটের আকার- ২০,৯৪৮ কোটি টাকা। এডিপি- ১১,০০০ কোটি টাকা।
১৯৯৫-৯৬: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ২৩,১৭০ কোটি টাকা। এডিপি- ১২,১০০ কোটি টাকা।
১৯৯৬-৯৭: বাজেট প্রস্তাবক- এসএএমএস কিবরিয়া। বাজেটের আকার- ২৪,৬০৩ কোটি টাকা। এডিপি- ১২,৫০০ কোটি টাকা।
১৯৯৭-৯৮: বাজেট প্রস্তাবক-এসএএমএস কিবরিয়া। বাজেটের আকার- ২৭,৭৮৬ কোটি টাকা। এডিপি- ১২,৮০০ কোটি টাকা।
১৯৯৮-৯৯: বাজেট প্রস্তাবক-এসএএমএস কিবরিয়া। বাজেটের আকার- ২৯,৫৩৭ কোটি টাকা। এডিপি- ১৩,৬০০ কোটি টাকা।
১৯৯৯-২০০০: বাজেট প্রস্তাবক- এসএএমএস কিবরিয়া।বাজেটের আকার- ৩৪,২৫২ কোটি টাকা। এডিপি- ১২,৪৭৭ কোটি টাকা।
২০০০-২০০১: বাজেট প্রস্তাবক- এসএএমএস কিবরিয়া।বাজেটের আকার- ৩৮,৫২৪ কোটি টাকা। এডিপি- ১৭,৫০০ কোটি টাকা।
২০০১-০২: বাজেট প্রস্তাবক- এসএএমএস কিবরিয়া।বাজেটের আকার- ৪২,৩০৬ কোটি টাকা। এডিপি- ১৯,০০০ কোটি টাকা।
২০০২-০৩: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৪৪,৮৫৪ কোটি টাকা। এডিপি- ১৯,২০০ কোটি টাকা।
২০০৩-০৪: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৫১,৯৮০ কোটি টাকা। এডিপি- ২০,৩০০ কোটি টাকা।
২০০৪-০৫: বাজেট প্রস্তাবক-এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৫৭,২৪৮ কোটি টাকা। এডিপি- ২২,০০০ কোটি টাকা।
২০০৫-০৬: বাজেট প্রস্তাবক-এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৬১,০৫৮ কোটি টাকা। এডিপি- ২৩,৬২৬ কোটি টাকা।
২০০৬-০৭: বাজেট প্রস্তাবক- এম সাইফুর রহমান। বাজেটের আকার- ৬৯,৭৪০ কোটি টাকা। এডিপি- ২৬,০০০ কোটি টাকা।
২০০৭-০৮: বাজেট প্রস্তাবক- মির্জা আজিজুল ইসলাম। বাজেটের আকার- ৯৯,৯৬২ কোটি টাকা। এডিপি- ২৫,৬০০ কোটি টাকা।
২০০৮-০৯: বাজেট প্রস্তাবক-মির্জা আজিজুল ইসলাম। বাজেটের আকার- ৯৯,৯৬২ কোটি টাকা। এডিপি-২৫,৪০০ কোটি টাকা।
২০০৯-১০: বাজেট প্রস্তাবক-এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ১,১৩,৮১৫ কোটি টাকা। এডিপি- ২৮,৫০০ কোটি টাকা।
২০১০-১১: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ১,৩২,১৭০ কোটি টাকা। এডিপি- ৩৫,১৩০ কোটি টাকা।
২০১১-১২: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ১,৬১,২১৪ কোটি টাকা। এডিপি- ৪১,০৮০ কোটি টাকা।
২০১২-১৩: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকা। এডিপি- ৫২,৩৬৬ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা। এডিপি- ৬০,০০০ কোটি টাকা।
২০১৪-১৫: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ২,৫০,৫৬০ কোটি টাকা। এডিপি- ৭৫,০০০ কোটি টাকা।
২০১৫-১৬: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ২,৯৫,১০০ কোটি টাকা। এডিপি- ৯৩,৮৯৪ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ৩,৪০,৬০৫ কোটি টাকা। এডিপি- ১,১০,৭০০ কোটি টাকা।
২০১৭-১৮: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ৪,০০,২৬৬ কোটি টাকা। এডিপি- ১,৪১,৩৮১ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯: বাজেট প্রস্তাবক- এ এম এ মুহিত। বাজেটের আকার- ৪,৬৪,৫৭৩ কোটি টাকা। এডিপি- ১,৭৩,০০০ কোটি টাকা।
২০১৯-২০ বাজেট প্রস্তাবক-আহম মুস্তফা কামাল। বাজেটের আকার ৫২৩১৯০ কোটি টাকা।