সংক্রমণের চূড়া খুঁজছে

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী রাজধানী সারাদেশ স্বাস্থ্য

সামাল দিতে ছক কষেছে সরকার
সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার পরামর্শ
শিগগির ভ্যাকসিন আসছে
মহসীন আহমেদ স্বপন : এখনো সংক্রমণের চূড়া খুঁজছে বাংলাদেশ। জানা নেই কবে নাগাদ বশে আসবে এই ভাইরাস। দীর্ঘদিন পর সংবাদ বুলেটিনে এসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বৃহস্পতিবার জানালেন করোনায় ভুগতে হবে আরো দুই তিন বছর।
কিন্তু এমন ধারণার সমীকরণ কি। আর এই দীর্ঘ সময় সামাল দিতে কি ছক কষেছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা বর্তমানে যেভাবে চলছি, এইভাবে একবছর দুবছর চালানো যাবে না। কাজেই কীভাবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সাথে বেঁচে থাকতে পারি। কেমন করে প্রাইভেট চেম্বারগুলো আগের মতো খুলে যায়, সে সঙ্গে বেসরকারি প্রাইভেট হাসপাতালগুলো আগের মতো করে চলে- সেটা নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।
এ দিকে দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩ হাজার ২৪৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৫ হাজার ৫৩৫ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৫ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১ হাজার ৩৮৮ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ২ হাজার ৭৮১ জন করোনা রোগী। সব মিলিয়ে সুস্থ হয়েছেন ৪২ হাজার ৯৪৫ জন।
শুক্রবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস বিষয়ক নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানান অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি জানান, করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৬ হাজার ৩২৭টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ১৫ হাজার ৪৫টি। এ নিয়ে দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো পাঁচ লাখ ৮২ হাজার ৫৪৮টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আরও তিন হাজার ২৪৩ জনের মধ্যে। ফলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৩৫ জনে। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন আরও ৪৫ জন। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হলো এক হাজার ৩৮৮ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও দুই হাজার ৭৮১ জন। সব মিলিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা এখন ৪২ হাজার ৯৪৫ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের ৩২ জন পুরুষ ও ১৩ জন নারী। এদের মধ্যে ১১ থেকে ২০ বছরের একজন, ২১ থেকে ৩০ বছরের তিনজন, ত্রিশোর্ধ্ব চারজন, চল্লিশোর্ধ্ব ১০ জন, পঞ্চাশোর্ধ্ব নয়জন, ষাটোর্ধ্ব ১১ জন, সত্তরোর্ধ্ব চারজন, ৮০ বছরের বেশি বয়সী তিনজন রয়েছেন। ৩২ জন মারা গেছেন হাসপাতালে এবং ১৩ জন মারা গেছেন বাসায়।
গত বৃহস্পতিবারের (১৮ জুন) বুলেটিনে জানানো হয়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৬ হাজার ২৫৯টি পরীক্ষায় করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আরও তিন হাজার ৮০৩ জনের দেহে। সে হিসাবে আগের ২৪ ঘণ্টার তুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমলেও বেড়েছে মৃত্যু। দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড আছে ৫৩ জনের। সে তথ্য জানানো হয় ১৬ জুনের বুলেটিনে। সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড আছে চার হাজার আটজনের। এ তথ্য জানানো হয় ১৭ জুনের বুলেটিনে।
শুক্রবারের বুলেটিনে বলা হয়, এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগী বিবেচনায় সুস্থতার হার ৪০ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে আরও ৬৮৪ জনকে এবং এ পর্যন্ত আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৫৫৫ জনকে। গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড় পেয়েছেন ২৩৬ জন এবং এ পর্যন্ত ছাড় পেয়েছেন সাত হাজার ৮১ জন।বর্তমানে আইসোলেশনে রয়েছেন ১১ হাজার ৪৭৪ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলিয়ে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৫৮৫ জনকে। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে তিন লাখ ৩৫ হাজার ২২৬ জনকে। গত ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড় পেয়েছেন দুই হাজার ২৩৭ জন। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইন থেকে মোট ছাড় পেয়েছেন দুই লাখ ৭২ হাজার ১৭২ জন। বর্তমানে হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলিয়ে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৬৩ হাজার ৫৪ জন।
দেশে কোয়ারেন্টাইনের জন্য ৬২৯টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দেয়া যাবে ৩১ হাজার ৯৯১ জনকে।
বুলেটিনে বরাবরের মতো করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকতে সবাইকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান ডা. নাসিমা।
এদিকে পরিসংখ্যান বিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যমতে, প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সারাবিশ্বে ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৩৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৪ জন। অপরদিকে সেরে উঠেছেন প্রায় ৪৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৩ জন।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলেও প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। দিন দিন করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব সরকারি-বেসরকারি অফিস। কয়েক দফা বাড়িয়ে এ ছুটি ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়। ছুটি শেষে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই ৩১ মে থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেয়া হয়। তবে বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এমনটা হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনা নিতে প্রয়োজন দক্ষতা। রোগীর সংখ্যা বিচারে সাজাতে হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় নিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ জাকের উল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে আমাদের যে সমস্ত রোগী আক্রান্ত হবে তাদেরকে চিকিৎসা দিতে পারবো না। একই সঙ্গে প্রত্যেক দিন, মাস ও বছরকে সুপরিকল্পনা করে আমাদের চলতে হবে।
বাস্তবতা যদি এমনই হয় তাহলে করোনাকালে পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির লাগাম টানতেও দরকার হবে বিশেষ পরিকল্পনা।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মকা-ে যদি নিরাপদভাবে চালিয়ে নেয়ার পরিস্থিতি তৈরি করতে পারি বা এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যঝুঁকির লাগাম টেনে ধরতে পারি এবং অনেক মানুষের টেস্ট করানো যায়, এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা তাদেরকে দেয়া যায়; তাহলে আমরা এর ভয়াবহতা কমিয়ে রাখতে পারবো। একই সঙ্গে অর্থনীতির কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবো।
তবে নানা আশঙ্কা থাকলেও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে, সাহস আর দৃঢ়তার সঙ্গে করোনা মোকাবিলার পরামর্শ তাদের।
শিগগির ভ্যাকসিন আসছে: বিশ্ব শিগগির করোনাভাইরাসের একটি কার্যকর ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে মহামারির অবসান ঘটাবে। ভ্যাকসিনের প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফলকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ আখ্যা দিয়ে এমন আশাবাদের কথা জানিয়েছেন স্বনামধন্য এই বিজ্ঞানী।
সংক্রমণের সংখ্যা ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানটি যুক্তরাষ্ট্রের। সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠা নিউ ইয়র্ক ও নিউজার্সি তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ২০টি অঙ্গরাজ্যে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়া ও টেক্সাসের মত যে এলাকাগুলোতে সংক্রমণের হার বাড়ছে, সেখানে লকডাউনের প্রয়োজন আছে কি না; এমন প্রশ্নের জবাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসের পরিচালক ফাউচি বলেন, ‘আমার মনে হয় না, লকডাউনে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আর কথা বলার কিছু আছে।’
বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই সার্স-কোভিড-২ ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টাকে ‘মুনশট’ আখ্যা দিয়েছেন। তাদের যুক্তি করোনাভাইরাসের জন্য সফল টিকা কখনও তৈরি হয়নি। এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রচেষ্টার পরও এইচআইভির কোনো টিকা পাওয়া যায়নি।
তবে ফাউচি বলছেন, ‘করোনাভাইরাসের টিকার সঙ্গে এইচআইভির টিকার তুলনা করা যাবে না। করোনাভাইরাসের টিকার বিষয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী, কারণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী এ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধী ক্ষমতা ভাইরাসটিকে পরাস্ত করতে পেরেছে। এ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃতি আপনার কাছে প্রমাণ হাজির করেছে যে এটি দূর করা সম্ভব।’


বিজ্ঞাপন