মানুষ মানুষের জন্য!

জাতীয় জীবন-যাপন

আমিনুর রহমান বাদশা : মানুষ মানুষের জন্য! কথাটি আরেকবার প্রমানিত হলো! করোনার এই মহামারি, ভয়াবহ বিপদের সময়ে পুলিশ নিজের জান-মাল দিয়ে জনগনের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের মানবিক দাবীর কাছে কখনো কখনো আইনের কঠিন শাসনও মাথা নত করতে বাধ্য হয়। তেমনি একটি মানবিক ঘটনা ঘটেছে মাদারীপুর জেলা পুলিশের মধ্যে! মাদারীপুর জেলা পুলিশের এসআই/ মোহাম্মদ নুরে আলম, যিনি উপরে অনেক কঠিন, কিন্তু ভেতরে কোমল মানবিকতার এক মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন! যেই মোহাম্মদ নুরে আলম দারোগার নাম শুনলে অনেক বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীর গলা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়, সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদীদের মতো বড় বড় আসামি পর্যন্ত যার হাত থেকে রেহাই পায় না, তিনিই কিনা আবার এ করোনাকালীন সময়ে কয়েকজন মানুষের গোপন কষ্ট দেখে, একজন কঠিন পুলিশ অফিসার হয়েও কিভাবে নরম মানুষে পরিনত হতে পারেন, তা ধরা পড়লো আমাদের অনুসন্ধানে ! তার ফেসবুক প্রোফাইলের সূত্র ধরেই সরেজমিনে আমরা ঘটনাস্থল মাদারীপুরের উত্তর হাজির হাওলায় গিয়ে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী রফিক ইরাদ হাওলাদারের মুখে শুনতে পাই, সেদিনের ঘটে যাওয়া কয়েকটি মানবিক ঘটনায়, পুলিশের ডিউটি ইনচার্জ মোহাম্মদ নুরে আলমের একটি মানবিকতার কথা।


বিজ্ঞাপন

তার ভাষ্যেই আমাদের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো, সেদিনের সেই ঘটনাটিঃ

লকডাউনের কথাঃ

সেদিন আমি করোনায় লকডাউন নিশ্চিতের জন্য কাজ করছিলাম! একটি মোটরসাইকেল সিগন্যাল দিয়ে আটকানো হলো। সেই গাড়ীতে মাঝ বয়সী তিনজন পুরুষ আছে। আমার পুলিশ প্রথমে জিজ্ঞেস করায়, তারা পুলিশের সাথে একটু খারাপ ব্যবহার শুরু করলো! এক পর্যায়ে কনষ্টবলেরা আমার কাছে তাদের তিনজনকে ধরে নিয়ে আসলো! আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা ৩ জন সম্পর্কে কি হন? তারা আমায় বললো, তারা আত্নীয়! তারপর আমি কৌশলে তাদের কাগজপত্র চেক করে ও জিজ্ঞাসাবাদে বুঝতে পারলাম, তারা আসলে আত্নীয় নন এবং এক এলাকারও নয় ! তখন তারা এক পর্যায়ে তিনজনই আমার কাছে সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হন। তখন আমি তাদের বললাম, যখন সারা বাংলাদেশে এত বড় একটা মহামারি চলছে, কেন আপনারা এই ঈদের আগের দিন ঢাকায় যাচ্ছেন? এতে করে আপনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন এবং আপনার পরিবার পরিজনও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে ! যে টাকা উপার্জনের জন্য আজ আপনি ঢাকায় যাচ্ছেন, সে টাকা উপার্জনের ঝুঁকি নিতে গিয়ে তো আপনি নিজেও মরবেন, সাথে আপনার পরিবার পরিজনকেও মারবেন ! যে পরিবারকে বাঁচাতে আপনারা আজ ঢাকায় যাচ্ছেন, আপনারা মরে গেলে তো সেই ছেলে মেয়েগুলোও চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যাবে? আপনারা বেআইনীভাবে একই সাথে দুটো অপরাধ করেছেন! তাই এখন আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবো!
তখন তারা আমায় যা বললো, তাতে আমার চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না! একজন বললো, স্যার আজকে আমার অবুঝ সন্তানটি সারাদিন না খেয়ে আছে! আমার শিশু বাচ্চাটি যদি ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরিয়ে আমার সামনে না খেয়ে থাকে, বাবা-মা ডাক ছেড়ে খাবার দাও বলে চিৎকার করে, তখন কি আমি ঠিক থাকতে পারি স্যার ? তখন তো আমার সামনে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না ! তাই আমি আজ ঈদের আগের দিন, ঈদের খুশি বাদ দিয়ে ঢাকায় কাজের খোঁজে যাচ্ছি! তার কথাগুলো শুনছিলাম, আর তখন আমার অবুঝ সন্তান আহনাফের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো! হায়… আজ যদি আমার সন্তান না খেয়ে থাকে তবে তো আমিও পাগলের মতো হয়ে যাবো!
তারা আমার পায়ে জড়িয়ে ধরে মাফ চাইতে এগিয়ে আসছিলো ! আমি তাদের সন্মান করে সরিয়ে দিয়ে বললাম, এবার আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো সত্য করে বলবেন! তাদের কথা শুনে ইচ্ছে হচ্ছিল যদি আল্লাহ আমায় আজ কোটিপতি করতেন, তবে আমি আজ তাদের তিনজনকেই ৩ লক্ষ টাকা করে দিয়ে দিতাম! আর বলতাম আজ থেকে ঘরে বসে বসে খান, আর ঘর থেকে বের হবেন না!
কান্না করতে থাকা ব্যক্তি তিনটিকে দূর থেকে সান্ত্বনা দিলাম! তাদের তিনজনকে কয়েকদিন খাবারের জন্য আমার পকেট থেকে বেতনের তিন হাজার টাকা দিলাম। কান্না জড়িত কন্ঠে তারা বললো স্যার আমাদের এবারের মতো মাফ করে ছেড়ে দিন! আমাদের জেলে দিয়েন না! আমরা সকলেই বাড়ি চলে যাবো! মাফ তো তাদের আমি মানবিকভাবে মন থেকে বহু সময় আগেই করে দিয়েছি! কিন্তু তখনও নিজেকে মাফ করতে পারছিলাম না! আজও সেই অব্যক্ত কষ্ঠে নিজেকে মাফ করতে পারিনি..!!

তখন ভাবলাম, আজ আমার সামনে যে অসহায় পিতা তার সন্তানের প্রতি এত বড় মমতা দেখালো, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিজের সন্তানের জীবন বাঁচাতে রাস্তায় নামলো, সেই পিতার প্রতি কি আমি আমার সীমিত সাধ্যে সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? পেরেছি কি আমার নিজস্ব আরও সম্পদ দিয়ে হলেও তাদের পরিবারকে আরও বেশি সাহায্য করে আমার পুরোপুরি মানবিক দায়িত্বগুলো পালন করতে? আজ যদি আমি তাদের আরও জরিমানা করি (পারবো হয়তো) তবে তারা আরও ব্যপক ক্ষতির মুখে পড়বে! আবার আইনের ছাত্র হিসেবে স্পষ্টই জানি, মানবিকভাবে মানুষকে বাঁচানোর কথাও সংবিধানে বলা আছে! আজ যেই সমাজ তাদের একদিন ত্রাণ দিয়ে আর কোন খোঁজ নেয়নি, তাদের প্রতি দায়িত্বের যে চরম অবহেলা করেছে, সেই সমাজ কি কোনদিন পারবে তার সমাজপতিদের এ অপরাধের দায় শোধ করতে? নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে আমার চোখের জল নীরবে টিপ টিপ করে গড়িয়ে পড়লো! কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না! অবাক চোখে সিপাহিকে তাদের ছেড়ে দিতে হাত দিয়ে ইশারা দিলাম… তারা চলে গেলো! আমি চোখের জল মুছে নির্বাক হয়ে তাদের দিকে অপলক চেয়ে রইলাম…

সম্পাদকের কথা : ★আবারো প্রমানিত হলো; পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশ জরিমানার টাকা নেওয়ার বদলে, উল্টো নিজের টাকা দিয়ে জনগণের সেবা করলো!
“শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে!”