রিজেন্টের ভবনগুলো দখল করা সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

অপরাধ আইন ও আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের তিনটি ভবনই বিভিন্ন ফন্দি করে ভাড়া নেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। মিরপুরের ১২ নম্বরের যে বাড়িটিতে হাসপাতাল করা হয়েছে সেটি অন্য আরেকজনকে দিয়ে ভাড়া করিয়েছিলেন। পরে সেখানে জোর করে হাসপাতাল স্থাপন করেন। দুই বছর ধরে এর ভাড়াও দেননি সাহেদ। উত্তরাতেও একই অবস্থা। ভুক্তভোগী বাড়িওয়ালা উকিল নোটিশ দিয়ে ও থানায় নালিশ করেও তাকে সরাতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরকে সাহেদের বিষয়ে সতর্ক করার পরও ঢাকার বাইরে তিনি পেয়েছেন পুলিশ প্রোটেকশন। হাসপাতালের কার্যক্রম নিয়ে যেখানে তোলপাড় চলছে, এবার এর অবকাঠামো নিয়ে এই অভিযোগ উঠলো। বুধবার বিকাল ৪টার দিকে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে একটি মোবাইল কোর্ট যায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের রিজেন্ট হাসপাতালে। হাসপাতালটি সিলগালা করার সময় সেখানে ছুটে আসেন ভবনের মালিক ফিরোজ আলম চৌধুরী। র‌্যাবকে পেয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেন তিনি।
ফিরোজ বলেন, আমি এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দিয়েছি ভবনটি। কিন্তু পরে দেখি আরেক ব্যক্তি এসে হাসপাতাল বানাচ্ছেন। আমি তার কাছে জিজ্ঞাস করলাম, কী ব্যাপার আমি তো ভাড়া দিয়েছি আপনার কাছে, উনি কে? তিনি বললেন, সমস্যা নেই। সেই যে ভবনে হাসপাতাল করলো, ভাড়া দেওয়ার পর থেকেই ভাড়া পাচ্ছি না। দুই বছরের ভাড়া বকেয়া। ভাড়া মন চাইলে ৫০ হাজার দেয়, না চাইলে দেয় না। আমি উকিল নোটিশ দিয়েছি, তাতেও কোনও কাজ হয়নি। এরপর থানায় জিডি করেছি, তাতেও কাজ হয়নি। সে ভবন ছাড়ে না। আমাকে কয়েকবার চেক দিয়েছে, কিন্তু চেক বাউন্স হয়েছে। সে প্রতারক।
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ২/এ সড়কের ১৪ নম্বর বাড়িটির দুইটি ফ্লোর ভাড়া নিয়েছেন সাহেদ। সেখানেই তিনি তার গ্রুপের অফিস করেছেন। এই অফিসের ভাড়াও নিয়মিত দেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভবনটির তৃতীয় ফ্লোরের মালিক এক নারী। ওই নারী বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। তার মা জাহানারা কবির বলেন, আমার স্বামী লুৎফুল কবির পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। আমার মেয়েকে ১৪ নম্বর বাড়িতে একটি ইউনিট কিনে দিয়েছি। আমার মেয়ে সেটি ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু সাহেদ নিয়মতি ভাড়া দেয় না। সে নিজেকে অনেক ক্ষমতাধর বলেও পরিচয় দেয়। দুই বছর ধরে সে ওই বাড়িতে আছে। আমরা তাকে তিনবার নোটিশ দিয়েছি, তারপরও বাড়ি ছাড়ে না। ভাড়াও দেয় না।
জানা গেছে, জুলফিকার আলী ভুট্টো নামে একজন পাথর ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকার পাথর নিয়ে তার টাকা পরিশোধ করেননি সাহেদ। উল্টো তাকে অফিসে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করেছেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো অভিযোগ করেন, আমি তার কাছে টাকার জন্য গেলাম। তখন আমার সঙ্গে তার লোকজন খারাপ ব্যবহার করছে। আমাকে হুমকি দেয়। তার লোকজন আমাকে আটকে রাখে। এরপর এক নারী আসে। তারপর তারা নাটক সাজায় আমি নাকি নারীকে নির্যাতন করছি। কয়েকজন লোক এসে সেখানে সাংবাদিক পরিচয় দিলো। তারা ছবি তুলে, কাগজে লিখছিল। আমি অবাক। এবিষয়ে আমি অভিযোগ দিতে গেলে থানা কোনও অভিযোগও নেয়নি।
২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ সাহেদের প্রতারণা বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা থেকে উপসচিব নওয়াব আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি আসে তৎকালীন মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, সাহেদ নিজেকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এডিসি ছিলেন বলেও পরিচয় দিয়ে আসছে। এই ব্যক্তি ‘ভয়ঙ্কর প্রতারক’। তার বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা রয়েছে, সে দুই বছর কারাবাস ছিল, সেই বিষয়েও উল্লেখ করা হয়।
এরপরও তার বিষয়ে তেমন কোনও আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। উল্টো এই চিঠির পরও ২০১৭ সালে সাজেক ভ্রমণে গেলে সেখানে তিনি পুলিশ প্রোটেকশন পান।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, আমরা গত দুই রাত ধরেই তাকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন জায়গায় আমরা খোঁজ করছি। বলে রাখতে চাই, সে অবশ্যই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে না। কারণ, কেউ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে না। যারাই আইনের ঊর্ধ্বে যাওয়ার চেষ্টা করবে আর সেই সাহস দেখাবে অবশ্যই তাকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম। তার বিষয়ে অন্যান্য সংস্থাও সতর্ক রয়েছে। সে দেশ ছেড়ে পালাতে পারবে না।
তিনি বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণার অভিযোগে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৯ জনকে আসামি করে একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার অন্যতম প্রধান আসামি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাহেদ পলাতক রয়েছে। অভিযানের পরই সে গা ঢাকা দিয়েছে। গতকাল রাতেও আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। সাহেদের মোবাইল নম্বরগুলো বন্ধ। প্রথমদিন দেখেছিলাম ফেসবুকে একটিভ ছিল, কিন্তু এখন সে সবকিছু থেকেই নিষ্ক্রিয়। তবে আশা করছি অতি দ্রুত তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবো।
প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই কোভিড ১৯ ডেডিকেটেড রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এসময় হাসপাতালে জাল রিপোর্ট ও করোনা সন্দেহ রোগীদের অসংখ্য নমুনা পাওয়া যায়। যেগুলো তারা পরীক্ষা না করেই মনগাড়া রিপোর্ট দিতো। এই ঘটনায় রিজেন্টের চেয়ারম্যান সাহেদ ও এমডি মাসুদ পারভেজসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছে র‌্যাব। আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা রিমান্ডে রয়েছে। তবে পলাতক চেয়ারম্যান সাহেদ।
সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : প্রতারণাসহ নানা অনিয়ম, সরকারের সাথে চুক্তি ভঙ্গ ও করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে র‌্যাব। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার পুলিশের পক্ষ থেকে ইমিগ্রেশন বিভাগকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, প্রতারণা মামলার আসামি সাহেদের বিরুদ্ধে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিনি যেন দেশের বাইওে যেতে না পারেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে।
গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়, উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। এরপর গত ৭ জুলাই রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় ১৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা থেকে আটক আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদসহ ৯ জনকে পলাতক আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে গত বুধবার রাতে র‌্যাব রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক সাহেদের প্রধান সহযোগী তারেক শিবলীকে গ্রেফতার করেছে।
করোনা টেস্টের জাল সনদ সরবরাহ এবং টেস্ট ও চিকিৎসায় অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।


বিজ্ঞাপন