মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

দিন বদলের স্বপ্নে গড়ে উঠছে

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কৃষি ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে সার্বিক অবদানের গুরুত্ব বিবেচনায় মোটামুটি ৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই গরুর পরেই মহিষের স্থান। গরু ও মহিষ প্রাণিসম্পদ খাতের দুটি প্রধান গবাদিপশুর জাত। পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি প্রাণি মহিষ। এই মহিষের জাত উন্নয়নে সরকার ১৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মহিষের জাত উন্নয়ন এবং মহিষের সংখ্যা বাড়ানো, দুগ্ধ উৎপাদনে মহিষের ভূমিকা জোরদার, আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, মহিষ খামারিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং মহিষজাত খাদ্যপণ্য গ্রহণে জনসচেতনতা বাড়াতেই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মহিষ উন্নয়ন (২য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দের পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি দেশের ৮টি বিভাগের ৪৯টি জেলার ২০০টি উপজেলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বাস্তবায়ন করবে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, গরুর তুলনায় মহিষের দৈহিক বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো, গরুর তুলনায় মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং এরা সামুদ্রিক জোয়ার-ভাটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে পারে। মহিষের মাংস ও দুধে কোলেস্টরলের মাত্রা গুরুর মাংস ও দুধ অপেক্ষা কম, তাই স্বাস্থ্যসম্মত। মহিষ হলো পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদনকারী গবাদি প্রাণি। ভারতসহ ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকটি দেশে উন্নত প্রযুক্তি, প্রজনন কৌশল ও ব্যবস্থাপনা মাধ্যমে মহিষের দুধ উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মহিষের জাত উন্নয়ন এবং মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধি, দুগ্ধ উৎপাদনে মহিষের ভূমিকা জোরদারকরণ, মহিষ খামারিদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং মহিষজাত খাদ্যপণ্য গ্রহণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাই এই প্রকল্পটি গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য।
এ প্রকল্পের আওতায় ছয় হাজার মহিষ পালনকারী খামারি এবং ৩৬০ জন কৃত্রিম প্রজননকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। মহিষের জেনেটিক উন্নয়নের জন্য ক্রসব্রিডিং, সিলেকটিভ ব্রিডিং এবং ইন্টার সি মেটিং প্রতিস্থাপন বিষয়ক গবেষণাও করা হবে এই প্রকল্পের আওতায়। সিলেট অঞ্চলের সোয়ামপ মহিষের হৃষ্টপুষ্টকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে এই প্রকল্পের আওতায়। বাগেরহাট মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামারে ১৬টি এবং টাঙ্গাইলে মহিষের বাছুর পালন কেন্দ্রে একটি শেড নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সাভারের মহিষের খামার এবং কৃত্রিম প্রজনন ল্যাবরেটরিতে প্রশিক্ষণ কাম ডরমেটরি ভবন নির্মাণ করা হবে। বিদেশ থেকে উন্নত জাতের মহিষ কেনা হবে ১৬টি। স্থানীয় উৎস থেকে কেনা হবে ২০০টি মহিষ। এছাড়া সাভারের কৃত্রিম প্রজনন ল্যাবরেটরির জন্য প্রকল্পের আওতায় রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও রি-এজেন্ট এবং ল্যাব যন্ত্রপাতি ও মহিষের কৃত্রিম প্রজনন সামগ্রীও কেনা হবে।
এ বছরের শুরু দিকে, সাভারে অবস্থিত মহিষ কৃত্রিম প্রজনন ও গবেষণাগারে মহিষের কৃত্রিম প্রজনন কর্মীদের ৪ মাস ব্যাপি ২য় প্রশিক্ষণ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, মহিষের মাংসে ও দুধে অ১অ১ জেনোটাইপ নেই, তাই যাদের ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ আছে তারা মহিষের মাংস ও দুধ খেতে পারবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ আবুল জব্বার শিকদার বলেন, মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গরুর চেয়ে অনেক বেশি, তার প্রমাণ খঝউ. তাছাড়া মহিষ প্রতিকূল আবহাওয়া ও নিন্মমানের খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকতে পার তাই আমাদের গরুর পাশাপাশি মহিষ পালনের দিকেও নজর দিতে হবে।
ডা. মুহসীন তরফদার রাজু এ প্রতিবেদককে জানান, মহিষের দুধে ফ্যাট এর পারসেন্টেজ বেশি, তাই মহিষের দুধের দাম বেশি এবং দধির জন্য একটি উৎকৃষ্ট দুধ। তাই দুধের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এবং প্রাণিসম্পদ ও পরিবেশ রক্ষা করার জন্য সরকার মহিষের দুধ উৎপাদন ও মহিষের কৃত্রিম প্রজনন বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার আগ্ বোহাইল গ্রামের শামসুল হক আকন্দ। এক দশক আগে ছিলেন জোতদার কৃষক। পাশের আওলাকান্দি গ্রামে ছিল প্রায় ১০০ বিঘা জমি। কিন্তু সেই জমি যমুনা নদী গ্রাস করে। পাঁচ বছর আগে পৈতৃক ভিটাও যায় নদীর পেটে। নিঃস্ব হয়ে পড়েন শামসুল। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নেন পাশের বোহাইল চরে।
শামসুল অন্যের জমিতে কুঁড়েঘর তুলে বসবাস শুরু করেন। দিনমজুরি করে এক বেলা ভাত জুটত তো আরেক বেলা জুটত না। কাজ না জুটলে উপোস থাকতে হতো। কূলকিনারা না পেয়ে বছর চারেক আগে দুটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নেন। সেই টাকায় মহিষের দুটি বকনা বাছুর কেনেন। পরে ধারদেনা করে কেনেন আরও দুটি বকনা বাছুর। মহিষের সেই চার বাছুরই আজ তাঁর ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাঁর খামারে এখন উন্নত জাতের আটটি দুধেল মহিষ ও মহিষের পাঁচটি বাচ্চা আছে।
শামসুল হকের স্ত্রী ছরভানু বেগম বলেন, ‘নদীডা হামাগরক ফরিকর বানাইছিল। বাড়িঘর হারায়ে পথের ফকির হইছিলাম। ছলপল লিয়ে না খ্যায়া থাকছি। মষ (মহিষ) হামাগেরে ভাগ্য বদলায়া দিছে।
শামসুল হকের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বোহাইল চরে আরও পাঁচ-ছয়জন মহিষের বাথান গড়ে তুলেছেন। সব বাথানই দুগ্ধ খামার। এর মধ্যে দক্ষিণ মাঝিরার আফজাল হোসেন ম-লের বাথানে ছোট-বড় ৪৯টি মহিষ, চর মাঝিরা গ্রামের অকছের আকন্দের বাথানে ৪০টি, চারনমারি গ্রামের ইসমাইল হোসেনের বাথানে ৩০টি, ওসমান আলীর বাথানে ৩০টি ছোট-বড় মহিষ আছে।
খামারিরা বলেন, বন্যা-নদীভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা চরবাসীর অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিয়েছে তাঁদের মহিষের খামার। মহিষ লালন-পালনের মধ্য দিয়ে দৈন্যদশা ঘুচে সচ্ছলতা ফিরেছে তাঁদের জীবনে।
অপরদিকে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ জেলা ভোলার অনন্য ঐতিহ্য মহিষ পালন। জেলায় প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে মহিষ পালন করা হয়ে আসছে বাথান পর্যায়ে। বাথানে একই সঙ্গে ২০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত মহিষ পালন সম্ভব। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বাড়িতে পালন শুরু করেছে। মহিষ পালনের ব্যাপকতায় এলাকার দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়ে উঠছেন। মহিষের দুধ বিক্রির টাকা কৃষদের চোখে দিন বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
এলাকায় মহিষ পালন করেন দোলাল মাতব্বর। মহিষ পালনে তার জীবন বদলে যাওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০১ সালে আমি চারটি মহিষ নিয়ে আমার যাত্রা শুরু করি। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে আমি শুরু করি। এখন আমার ৩৬টি মহিশ। শুধু তাই নয়, বর্তমানে আমার দুই একর জমি হয়েছে। যার স্থানীয় বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা। এ মহিষের দুধ বেচে আমি আমার সংসারের খরচ মেটাই। আমার দুই মেয়ে ও তিন ছেলে। মেয়ে একটার বিয়ে দিয়েছি। তাও এই মহিষের দুধ বিক্রির টাকায়। তিনি জানান, মহিষ পালন অত্যন্ত লাভজনক। এক লাখ টাকা দিয়ে মহিষ কিনলে দুই বছর পরে পাওয়া যাবে একটি বাচ্চা। বাচ্চা বিক্রি করে পাওয়া যায় ৩০ হাজার টাকা আর দুধ বিক্রি করে পাওয়া যায় ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে এক লাখ টাকায় ৫০ হাজার টাকা লাভ। তাই ভোলায় এখন এ মহিষ পালনে সবাই ঝুঁকছে। এতোদিন শুধু বাতানে পালন হলেও এখন তা বাড়িতে বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশেও পালন হচ্ছে। মহিষ পালনে দিন বদলের এ গল্প ভোলা জেলার অনেক কৃষকের।


বিজ্ঞাপন