মো. কিশোর : গ্রামের দক্ষিণপাশে খোলামাঠ। যতদূর চোখ যায়।বর্ষাকালে পানিতে থইথই আর শুকনো মওসুমে ফসলের হাসিতে ভরে ওঠে মাঠ। গ্রামের পশ্চিম আর দক্ষিনপাশে সংযোগ স্থলে ‘বাগলার খাল’ এসে গ্রামের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। বাগলার খাল যেখানে সংযুক্ত হয়েছে সেখানে পরবর্তীতে একটা বৃহৎ পুকুর খোড়া হয়েছিল আশির দশকে যাকে এখন দীঘি বলা হয়। আর এই দীঘির আশেপাশে গ্রামের খাঁন বংশের বসবাস। দু একজন হয়ত একটু শিফট করেছে কিন্ত মূল শেকড়টা ওখানেই রয়ে গেছে।
মহম্মদ খান,ইরাপ খান, রুস্তম খান খাঁ বংশের সন্তান। তাদেরই সন্তান সন্ততিরা এখন ওখানে বাস করে। আগে সবাই সন্নিবেশিত ছিল কিন্ত জীবনের প্রয়োজনে অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।
দীঘির পাশে দাঁড়ালে খোলা দক্ষিনাকাশ কিম্বা পশ্চিমাকাশ চোখে পড়বেই।
মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো নারকেলগাছ, তালগাছগুলোর পাতায় শন শন করে বাতাস নেচে যায়।পাখিরা উড়ে এসে বসে ডানা জিড়োয়।ফুলতলা গামী ধানচালের নৌকাগুলো এখান থেকে রওনা হয়ে যায় রবি বুধবারে আবার সদাই-পাতি করেবএখানেই ফিরে আসে। খালের পাড়গুলোতে আলকাতরা দেয়া নৌকা গুলো মোটা শেকল আর কামারের তৈরী তালা দিয়ে গাছের সাথে আটকানো থাকে। কিছু আবার পানিতে ডোবানো থাকে। ডুবিয়ে রাখলে কাঠ নাকি ভাল থাকে উপরন্ত নৌকা সেচলে একদিনের মাছও জমা হয় নৌকার গলুইতে। একটা ছন্দময় জীবনের ছোঁয়া বাগলার খাল সংলগ্ন এলাকায় লক্ষ্য করা যায়।
এই বিখ্যাত খাঁ বংশের রুস্তম খাঁর তৃতীয় পুত্র খান শহীদ বা গ্রামের অতিপরিচিত মানুষ শহীদ খাঁ একজন শিল্পির মানসিকতা নিয়ে জন্মগ্রহন করেন। দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েনে তার শিল্পি সত্বা তেমন করে বিকাশ লাভের সুযোগ পায়নি তাই তাকে কাঁধে নিতে হয়েছিল সিঙ্গার সেলাই মেশিন, বাজারে বসাতে হয়েছিল টেইলারিং সপ।
ছোটবেলা থেকে শহীদ খাঁ ভীষন ডানপিটে থাকলেও তার মধ্যে নতুন আইডিয়া বা ভাবনার কমতি ছিলনা। বাজারে পোশাকের কারিগর হিসাবে ছিলেন স্বনামধন্য। তার এই পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন তৎকালীন যুবক সসম্প্রদায়ের নেতা-উদ্যোক্তা। তার টেইলারিং সপ টা বাজারের কেন্দ্রস্থলে হওয়াতে এলাকার আমুদে যুবকেরা তার দোকানে জমিয়ে দিত আড্ডা। সেই আড্ডাস্থলের মাথার উপরে তিনি নিজ হাতে তৈরী করেছিলেন সুদৃশ্য একটি হাতেটানা পাখা যার রশিটা ছিল তার বসার স্থানে বাঁধা। বসে বসে রশি ধরে টানলে সারাঘরর বয়ে যেত বাতাসের দুরন্ত ঢেউ। মূলত এই হাতে টানা পাখার আইডিয়া আরব থেকে মুঘলেরা নিয়ে আসে। তারপর বৃটিশ আমলে অফিসে, কোর্টকাচারি এবং সম্পদশালীরা এই পাখা ব্যবহার করতেন। কোন গরীব পরিচারক টাইপ কাউকে দিয়ে রশি টানানো হত। তাদের বলা হত পাঙখাবরদার।
শহীদ খাঁ-র এই হাতেটানা পাখার আইডিয়া সম্পর্কে আমাদের পূর্বাপর কোন জ্ঞান ছিলনা তাই দেখে অবাক হয়ে থাকতাম আমরা। ছোট ছিলাম বলে অবাকটা বেশি হতাম। হার্ডবোর্ড আর রঙিন কাপড়ের ঝালর লাগানো এই পাখা আর এ থেকে উৎপন্ন বাতাস আমাদের কাছে এক অতি আশ্চর্য বিষয় বলে বিবেচিত হত।
দুপুর বেলায় সারাবাজার যখন প্রায় ফাঁকা হয়ে যেত তখন এই পাখার নীচে জমা হত গ্রামের আমুদে যুবকেরা। দোকানের খাটের উপর গোল হয়ে বসে মাঝে মধ্যে ব্রিজ খেলত, অথবা কোরাস গাইত-
‘ দেখ না মন ঝকমারিয়ে দুনিয়াদারী – – ‘
সেই সুর বাজারের অলস দুপুরবেলার নির্জনতা খান খান করে বাজারের উত্তর পাশে ঝাকড়া মাথার গাবগাছের দিকে উড়ে চলে যেত, আর রুমের মধ্যে রয়ে যেত হাতটানা পাখার সঞ্চালন।
সেই সুর আর সঞ্চালন আমাদের মোহিত করে রাখত দোকানের সামনে। অজানা আকর্ষনে আমরা দোকানটাকে ঘিরে থাকতাম। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমরা দর্শকের ভূমিকায় থেকেছি অনেকবার।
একহারা গড়নের লম্বা শহীদ খাঁ খানিকটা ঝুঁকে হাটতেন। সেটা লম্বা হওয়ার কারনেও হতে পারে।তার একটা শারীরিক সমস্যা ছিল। তার হাত ও মাথা ক্রমাগত কাঁপতে থাকত। অবাক করা বিষয় হল তার এই শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও তিনি চমৎকারভাবে কাপড় কাটতেন। মাখালা চাচীদের একটা নির্ভরযোগ্য জায়গা ছিলেন তিনি।
হটাৎ একদিন দেখি তিনি চমৎকার কিছু কলম( বলপেন) বানিয়েছেন বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে। তখন উইনসাং/ইয়ুথ আর ইকোনো কলমের যুগ। কিন্ত তারপরও তার তৈরীকৃত কলমগুলো দারুন জনপ্রিয় হয়। ভীষণ নিখুঁতভাবে তিনি কলমের দেহ মাথা তৈরি করতেন। হাতের কাজের এক চুড়ান্ত উদাহরণ। এরপর দেখি তিনি বাঁশ দিয়ে ২/৩ ব্যাটারির টর্চও বানিয়েছেন।
তার তৈরিকৃত এইসব দ্রব্যাদির নিখুঁত চেহারা সবার মনে নাড়া দিয়ে গেছিল। অবাক হয়েছিলাম,কিভাবে নিজের হাতে কোন মেশিনের সাহায্য ছাড়াই কিভাবে তৈরি করে!
শুনেছি, তিনি ও তার ভাই তৌহিদ খাঁ মিলে তার বাবা রুস্তম খাঁকে নিয়ে অনেক দুষ্টামী করতেন। সেসবও একেকটা কাহিনী। অনেকেই জানেন।
শহীদ খাঁ বা খান শহীদের মত এমন গুনী শিল্পি আমাদের গ্রামে আর জন্মায়নি। তার শিল্পি সত্বা বা উদ্ভাবনী সৃষ্টি হয়ত কোন পৃষ্টপোষকতা পেলে আরো অনেকদূর যেতে পারত। কিন্ত অজপাড়াগাঁয়ের একজন মানুষ যখন জীবিকার জন্যে প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তার শিল্পি সত্বা একদিন ধীরে ধীরে মরে যায়।
যুগ এগিয়ে যায় আর এসব মানুষ গুলো পিছিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যায় একদিন। তবে তার সৃষ্টিগুলো শৈশবে দেখে অবাক হয়েছিলাম বলেই আজকে তার স্মৃতিচারন। সেজন্য তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
মানুষটা আজ বেঁচে নেই।
আল্লাহ যেন তার জীবনের সকল ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করে বেহেস্ত নসীব করেন। আমিন।