হামলাকারী চিহ্নিত

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র সারাদেশ

সরকারি বাসভবনে ঢুকে ইউএনর ওপর হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের সরকারি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ এ তথ্য জানান।
বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সরকারি বাসভবনে ঢুকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম (৩৫) ও তার বাবা ওমর আলীকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। অবস্থার অবনতি ঘটলে আহত ওয়াহিদা খানমকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। অবস্থা অত্যান্ত গুরুতর এবং রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (গতকাল সন্ধ্যা ৮টা) অচেতন অবস্থায় রয়েছেন তিনি।
গতকাল বিকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক দীন মোহাম্মদ জানান, ইউএনওর মাথার আঘাত অনেক জটিল ও গুরুতর। ওয়াহিদা খানমের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। হাতুড়ির আঘাতে তার মাথায় দেড় ইঞ্চি পরিমাণ গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউএনওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মাথার খুলির হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। এটি মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে প্রচ-ভাবে। ভেতরে রক্ত রক্ষণ হয়েছে। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল না। ব্লাড প্রেশার কমে গেছে। জ্ঞানের মাত্রা সাধারণ মানুষের মতো নেই; যদিও তিনি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করছেন। তিনি প্রেশার ধরে রাখতে পারছেন না। প্রেশার কমে গেছে। তাঁর পালস বেড়ে গেছে। তিনি রেস্টলেস অবস্থায় আছেন। আগে তাঁকে স্টেবল (স্থিতিশীল অবস্থা) করতে হবে। অপারেশন (অস্ত্রোপচার) করার মতো অবস্থা নেই। এখন অপারেশন করলে বিপজ্জনক হবে। আগে তাঁর অবস্থার উন্নতি করাতে হবে। ব্লাড, স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো ওষুধ দেওয়া হয়েছে।’
ইউএনও কেমন শঙ্কায় আছেন এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জাহেদ হোসেন বলেন, ‘শঙ্কাটা কতটুকু, বলা কঠিন। তবে উনি সংকটাপন্ন অবস্থাতেই আছেন। ওনার ব্লাড প্রেশার, পালস রেট ও জ্ঞানের মাত্রার অবস্থার উন্নতি না হলে উনি যথেষ্ট বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। যেকোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেও যেতে পারে।’
ইউএনওর চিকিৎসায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি মেডিকেল টিম গঠন করেছে। এই দলে আছেন হাসপাতালের পরিচালক দীন মোহাম্মদ, নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন, হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক বদরুল আলম, চিকিৎসক এম এম জহিরুল হক, চিকিৎসক আমিন মোহাম্মদ খান, চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান ও চিকিৎসক উজ্জ্বল কুমার মল্লিক।
জানা গেছে, রাত আড়াইটার দিকে এক যুবক ইউএনওর সরকারি আবাসিক ভবনে ঢুকে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে শুরু করে। এ সময় তার চিৎকারে তার সঙ্গে থাকা বাবা ছুটে এসে মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে ওই যুবক তাকেও কুপিয়ে জখম করে। এ সময় অন্যান্য কোয়ার্টারের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। এ সময় তাদেরকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদেরকে রংপুরে পাঠানো হয়। সেখানে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে রংপুর ডক্টরস ক্লিনিকে আইসিইউতে ও তার বাবাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তি করা হলে অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকলে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
ওয়াহিদা খানমের বাবার নাম ওমর আলী। নওগাঁ থেকে মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা বাবা ওমর আলী। ওয়াহিদা খানমের স্বামী মেজবাহুল হোসেন রংপুরের পীরগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তাদের তিন বছরের ছেলে সন্তান রয়েছে। হামলার সময় শিশুটি ঘুমন্ত ছিল। বর্তমানে সে ভালো আছে।
এ দিকে, ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলাকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। বৃহস্পতিবার দুপুরে ইউএনও’র সরকারি বাসভবনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে হামলাকারীকে চিহ্নিত করা হয়।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হাসান জানান, সিসিটিভি দেখে আমরা হামলাকারীকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এই ব্যাপারে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনী প্রদক্ষেপ নেয়া হবে। বিষয়টা নিয়ে এখন একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আছি। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
ঘটনার বিবরণে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাহমুদুল আলম জানান, আনুমানিক রাত ৩টার দিকে ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে দুর্বৃত্তরা প্রবেশ করে। প্রথমে তার বাবাকে আহত করে পাশের ঘরে বাথরুমে আটকে রাখে। পরে ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা চালায়। এলোপাতাড়িভাবে তাকেও পিটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। মূলত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে বলে ধারণা জেলা প্রশাসকের।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম, তিনি বিসিএস ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি সেখানে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন, তার বাবাও সেখানে ছিলেন। তার হাজবেন্ডও পীরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি দোতলায় থাকেন। বুধবার রাত প্রায় ৩টার দিকে দোতলার বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে দুজন দুর্বৃত্ত ঢোকে। তাকে হাতুড়ি দিয়ে মাথার পেছনের অংশে আঘাত করে। সে গুরুতর আহত হয়। মাথা ফেটে অনেক রক্তক্ষরণ হয়।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ওয়াহিদা খানমকে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে আমরা ঢাকা নিয়ে এসেছি। ইতোমধ্যে তাকে ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে বেশ সিরিয়াস পর্যায়ের রোগী। তার একটা সাইড প্যারালাইজড মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার (এসপি) এখনও ঘোড়াঘাটের ইউএনওর বাসায় অবস্থান করছেন। আমরা কিছুক্ষণ আগে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেক্ষেত্রে বিষয়টি কী হয়েছে এবং এই দুর্বৃত্তরা কারা, সেই বিষয়ে এসপি সাহেব বললেন, আমরা একটু সময় পেলে আমরা খুব দ্রুত দুর্বৃত্তদের নাম ঠিকানা বের করতে পারব। আমাদের প্রচেষ্টা আছে, আমরা আশাবাদী খুব দ্রুত এটা করতে পারব।’
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সেখানে (ইউএনওর বাসভবন) সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু দুর্বৃত্তের মুখে মুখোশ ছিল। সেগুলো দেখে পর্যালোচনা চলছে। সেখানে পুলিশের চৌকস একটি টিম কাজ করছে। তারা আশাবাদী যে, খুব দ্রুত আমাদের জানাতে পারবেন। কারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা তাকে (ইউএনও) সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। যা যা করা প্রয়োজন আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সেটি করছি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক হঠাৎ করে এ রকম একটি বিষয়। জানতে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে, দুর্বৃত্তরা কারা আসলে?’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কী ডাকাতির উদ্দেশে এসেছিল, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কারণে শত্রুতা তৈরি হয়ে এ রকম হয়েছিল কি না? আমি ডিসি সাহেবকে (দিনাজপুরের ডিসি) জিজ্ঞাসা করেছি, এমন কোনো কিছু হয়েছিল কি না শত্রুতাবশত। ডিসি সাহেব বলেছেন, না, আমাকে তো….। কোনো একটা কিছু হলে, নির্বাহী কর্মকর্তা ডিসি সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করেন। কোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোনো সমস্যা হলে সেটা জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়। এ রকম কিছু তার (ওয়াহিদা খানম) পক্ষ থেকে অবহিত করা ছিল না। যার কারণে পুরোপুরি ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তার পিতাও কিন্তু আহত। যদি মনে করতাম, কোনো শত্রুতাবশত তাহলে সে একা আক্রান্ত হতো। তার পিতা একজন বয়স্ক মানুষ, সেও কিন্তু আক্রান্ত হয়েছে। তার মানে হয়তো ব্যাপারটা ডাকাতির উদ্দেশে বা এ রকম কিছুও হতে পারে।’ ইউএনও ওয়াহিদা খানমের একটি ছেলে সন্তান আছে। তার বয়স ৩ বছর বলেও জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। ‘আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখছি। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে এই জটটা খুলবে। আমরা অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব’ বলেন তিনি।
পারিবারিক শত্রুতা থেকে এমনটা হতে পারে কি না- এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পারিবারিক শত্রুতা এমন কিছু মনে হচ্ছে না। তদন্তেই সব বের হয়ে আসবে। তবে এমনও আমরা জিজ্ঞাসা করেছি, কোনো কিছু খোয়া গেছে কি না, সেই রকমও কেউ কিছু বলতে পারছে না।’ কোনো তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে কি না- এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। পুলিশই এটার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার নিজেই এটা তদন্ত করবে।’ এই ঘটনায় মামলা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রীর পাশে থাকা জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘এখনও মামলা হয়নি, মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।’ ইউএনওর পিতার জ্ঞান ফিরেছে বলেও জানান সচিব।
এ বিষয়ে ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা-ওসি আমিরুল ইসলাম জানান, প্রথমে নির্বাহী কর্মকর্তার বাবাকে আহত করে বাথরুমে আটকে রাখে। এরপর নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। বাসভবনের নাইট গার্ডকে তালা দিয়ে আটকে রাখে। কাজের মেয়েও নিচে ছিল। এটি কোনো ডাকাতি ছিল না, সম্ভবত হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা চালানো হয়েছে বলে মনে করেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম, পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।


বিজ্ঞাপন