৯ম শ্রেণি পাস এমপি হতে চান!

এইমাত্র রাজধানী রাজনীতি

শক্তিশালী প্রার্থী নেই ঢাকা-১৮ আসনে

*অস্বাভাবিক সংখ্যার মনোনয়ন প্রত্যাশী দেখে
নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে


বিজ্ঞাপন

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর প্রয়াত সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-১৮ আসনে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ৫৬ জন। এর মধ্যে নবম শ্রেনী পাশ, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজসহ স্থানীয় নেতা-পাতিনেতারাও এমপি প্রার্থী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
এই অস্বাভাবিক সংখ্যার মনোনয়ন প্রত্যাশী দেখে নেতাকর্মীদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। হাই কমান্ডও অনেকটা বিস্মিত। দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, যোগ্য ও শক্তিশালী প্রার্থীর অভাব থাকায় এই আসনে অনেকেই দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তবে সমালোচনাকারীরা বলছেন প্রাপ্তি এবং ভোগের যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় এতো সংখ্যক আগ্রহী প্রার্থী। তাছাড়া এটা দর-কষাকষিরও অংশ।
যদিও প্রকাশ্য বক্তব্যে আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা বলেন, দল করলে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের অধিকার সবারই আছে।
দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের লক্ষ্য জনকল্যাণ করা। সেজন্য সবাই জনপ্রতিনিধি হতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই আসনে ফরম সংগ্রহকারীদের সংখ্যা কিছুটা দৃষ্টিকটু বলেও স্বীকার করেন তিনি।
প্রয়াত এমপি সাহারা খাতুনের আসনে ৫৬ মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগের সাবেক ও বর্তমান নেত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক সচিব, পুলিশের সাবেক ডিআইজি, সাবেক জেলা জজ, চিকিৎসক, শিক্ষক ও কাউন্সিলর।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এতো অধিক সংখ্যক মনোনয়ন কেনার বিষয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। যুবলীগ নেতা কবীর হোসেনের কাছে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাজনীতি থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রয়াত সংসদ সদস্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন। এখানে তার মতো কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত। কিন্তু ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের নেতারাও ফরম কিনেছেন। সিনিয়রদের সম্মান দিয়ে তাদের বিরত থাকা উচিত ছিল বলে মন্তব্য তার। যুবলীগের গত কমিটির এই নেতা বলেন, যে খাই খাই স্বভাব গড়ে উঠেছে, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ, যদি লাইগা যায় এর মতো।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনতে দোষ নাই। যেহেতু বড় ও শক্তিশালী প্রার্থী দেখা যাচ্ছে না, তাই হয়তো এতো বেশি নেতাকর্মী আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
ঢাকা-১৮ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুল হাফিজ মল্লিক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মমতাজ উদ্দিন মেহেদি, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের খান, যুবলীগের সভাপতিম-লীর সাবেক সদস্য মো. আবুল বাশার, যুব মহিলা লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাজমা আকতার, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মতিউর রহমান, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আব্দুল ওয়াদুদ প্রমুখ। এছাড়া বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শাহাজান আলী ম-ল, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মজিবুর রহমান, ভাষানটেক থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো. ইয়াজ আলী ফকির, ডিএনসিসির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহিদুল ইসলাম মোল্লা, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী রবিন, চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ রাজ্জাক খান, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য মুনতাজুল করিম, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. খসরু চৌধুরী, আওয়ামী লীগের উপকমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক নাজমুল হক বাবু, সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসা, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নূরুজ্জামান, মহিলা লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ রেবেকা বেগম, সাবেক উত্তরখান ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক নির্মল ডিকস্তা, খিলক্ষেত থানা যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও ৫০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ডিএম শামীম, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. হাবিব হাসান, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মোহা. কবির হোসাইন, চাঁদপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য কাজী খলিলুর রহমান, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল শাখা স্বাচিপ সভাপতি ডা. সাব্বির আহমেদ খান, তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এসএম হোসাইন, মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাসিমা ফেরদৌস, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির সাবেক সদস্য মোজাম্মেল হোসেন মাতুব্বর (আমিনুল), ভাটারা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান, ১৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য জিন্নাত আলী, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি শেখ মামুনুল হক, যুবলীগ নেতা হৃদয় চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মো. রেজাউল করিম, হাজী জিন্নাত আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মোহাম্মদ, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ ওয়ালী আল কাদির, পাবনার বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুল আজিজ খান, ফরিদপুর কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শামীম রেজা ও উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের সদস্য (প্রস্তাবিত) এস ফয়সাল আহমেদ প্রমুখ।
তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাবিব হাসানও রয়েছেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা হাবিব হাসান গুরুত্বপূর্ণ ওই আসন থেকে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। এতে দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দল থেকে হাবিবকে মনোনয়ন দিলে ওই আসনটি হারাতে পারে আওয়ামী লীগ এমন দাবি স্থানীয় নেতাকর্মীদের।
সূত্রমতে, মোহাম্মদ হাবিব হাসান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনের হলফনামায় তিনি নবম শ্রেণি পাসের কথা উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা-১৮ আসনে যারা মনোয়ন প্রত্যাশী তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হলেন হাবিব হাসান। তিনি পারিবারিকভাবে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ভূমি দখলসহ একাধিক মামলাও রয়েছে।
উত্তরা ৩নং সেক্টরের ২৭ নং প্লটে লতিফ এম্পোরিয়াম মার্কেটেও দুটি দোকান দখলের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, হাবিব একজন ভূমিদস্যু এবং চাঁদাবাজ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। ভূমিদস্যূ ও চাঁদাবাজীর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগে তাকে একাধিকবার পুলিশ গ্রেফতার করে।
এ বিষয়ে খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেরামত আলী বলেন, আমি নিজেও এ উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। আমরা চাই এ উপনির্বাচনে একজন শিক্ষিত ও ভালো মানুষ মনোনয়ন পান। দলের নীতিনির্ধারকেরাও একজন ভালো লোককে মনোনয়ন দিবেন বলে আমরা আশাবাদী।
এসব অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী মোহাম্মদ হাবিব হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি এসএসসি পাশ করেছেন। গত ১২ বছরের ইতিহাসে তুরাগও উত্তরা পশ্চিম থানায় তার বিরুদ্ধে কোন মামলা নাই। আমি কারো কোন জায়গা-জমি দখল করি নাই।
উল্লেখ্য, ঢাকা-১৮ আসনে গত ১২ বছর ধরে এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তার মৃত্যুতে এ আসনটি শূন্য হয়। তাই ওই আসনের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ করছে আওয়ামী লীগ। তবে ওই আসনে কেমন প্রার্থী দেয়া হবে এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে নানা ঝল্পনা-কল্পনা। যদি কোনো ব্যবসায়ী ও অনুপ্রেবশকারীকে মনোনয়ন দেয়া হয় তা হলে ওই আসনটি আওয়ামী লীগ হাত ছাড়া করবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।