কাজি আরিফ : তিন্নি একটা সাদা গাড়িতে করে কলেজে আসে । গাছ থেকে টুপ করে নিঃশব্দে যেমন করে পাতা ঝরে যায় তেমনি আস্তে করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুততম সময়ে মেয়েদের কমন রুমে চলে যায়। এরপর ক্লাসে শিক্ষক আসার ঠিক আগে আগে দ্রুত ক্লাসে ঢুকে বসে পড়ে এক কোনায়। মুখে হাসি নেই । হাসি থাকবেনা এটাই যেন স্বতসিদ্ধ। এটা সবাই মেনেই নিয়েছে এক প্রকার।
তাকে দেখলেই সুকুমারের রামগরুড়ের ছানা কবিতাটা মনে পড়ে ।
কিন্ত রামগরুড়ের চেহারা মনে পড়লে কবিতাটা হাওয়া হয়ে যায়। কেননা তিন্নির চেহারা খুব সুন্দর। অসম্ভব রুপবতী একটা মেয়ে সে।
বরং তাকে দেখে মনে পড়বে জীবনানন্দ দাসের সুরঞ্জনা , সুচেতনা কিম্বা বনলতাকে । কি জানি, জীবনানন্দের কবিতার নারীরা হাসতেন কিনা ?
‘শঙ্খের মত সাদা দাঁতের হাসি’ ?
তিন্নির দাঁত কেন , প্রসারিত ঠোট্টুকুও দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের কারোর। তিনি যে কবে হাসেন কে জানে ? হয়ত হ্যালির ধুমকেতুর মত হাসেন। আর সেজন্য কি আমাকে বসে থাকতে হবে সত্তর বছর ? এক হাসি দেখতেই সত্তর বছর !
সারাক্ষন কুলুপ আটা ঠোঁট দুখানি যেন সেফটিপিন বা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। বড় বড় চোখতুলে নাটোরের বনলতার মত তাকান বটে কিন্ত মুখ খোলেন না। যদিও বা মুখ খোলেন কিন্ত তাকে আশে পাশের কেউ হাসতে দেখেছেন বলে কারো মনে পড়েনা।তাই আমি তার নাম দিয়েছি হ্যালি আপা। কট্টর বন্ধুরা তাকে বলে, রাম গরুড়ের ছানা।
হ্যালির ধুমকেতুর মত কবে তার হাসি দেখা যাবে ঠিক নেই । কবে তিনি হাসবেন কেউ জানেনা।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় শার্লক হোমসের মত সন্ধিৎসু হয়ে খুজে ফিরি তার না হাসার কারন। কিন্ত কোন থিওরী ব্যবহার করে তার না হাসার কারন যখন বের করা যায়না তখন হাল ছেড়ে দিয়েছি।
কি অবাক কান্ড একটা আঠারো ঊনিশ বছরের মেয়ে হাসবে না , এটা সম্ভব ?
হ্যালী আপা মানে তিন্নি আমাদের ক্লাসের সবচে সুন্দরী আর ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। সচরাচর এমনটা কিন্ত দেখা যায়না। সুন্দরী আর ভাল ছাত্রী এমন সম্মিলন এ ধরাধামে খুব কম। সুন্দরীরা সাধারনত বোকা সোকা ধরনের হয়। আমাদের ধারনা ছিল, সাজুগুজু আর আসন্ন বিবাহ বা বরের কল্পনায় কেটে যাবে তাদের কলেজ জীবন । কিন্ত আমাদের সেসব সনাতন ধারনা পালটে দিয়ে তিন্নি প্রতিটা পরীক্ষায় বিপুল ব্যবধানে আমাদের থেকে এগিয়ে থাকে । দেখে আমাদের মাথা কাটা যায় লজ্জায়।
যদিও লজ্জার মত সামান্য বিষয় আমাদের মাথায় বেশিক্ষন অবস্থান করেনা ।পড়ালেখার কথা ভুলে ফের আড্ডায় গল্পে গুজবে মনোনিবেশ করতে থাকি। বাংলা সিনেমায় বা ভিসিআরের হিন্দি সিনেমা আমাদের তখন প্রেমিক বানিয়ে তুলছিল একটু একটু করে । আমরাও নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছিলাম পর্দার রঙিন জীবনের কল্পনায়। কখনো কখনো এক টিকিটে দুছবি ও তার চৌম্বক অংশ নিয়ে একে অপরে খাজুরালাপ করি আনন্দের সাথে।
তাই অন্তঃপুরের গোমড়া মুখের মেয়ের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক হয়না ।
মাঝে মাঝে আমরা ক্লাস না করে কলেজের নদীর পাড়ে গোল হয়ে বসে আড্ডা পেটাই। কেউ কেউ তাস পেটায়। সিগারেট ফুঁকি । আর ওদিকে কুলুপআটা ্মেয়েটা অচেনা রয়ে যায় জনমের মত। মেয়েটা অজানা মেরু বা অজানা সমুদ্র পৃষ্টের মত রয়ে আমাদের কাছে , এবং আমার কাছেও।
একদিন আমাদের বন্ধু অপু অনেক আগ্রহ নিয়ে খানিকটা শার্লক হোমসের শ্যালকের মতকিছু তথ্য এনে আমাদের জানায়-
‘’শোন, তিন্নি হল ডিসি সাহেবের মেয়ে। ডিসি সাহেবের স্ত্রী নেই মানে তিন্নির মা নেই। কেন নেই তা জানিনা। মৃত্যু বরন করেছেন নাকি ছেড়ে গেছেন এটা কেউইই বলতে পারেনা”
আমাদের চরম ব্যস্ততার মধ্যে তিন্নির অমন তথ্য খুব একটা রেখাপাত করেনা। কিক্ত কোথায় একটা অতৃপ্তি থেকেই যায়। মেয়েটা কেন হাসবেনা। হোয়াট ইজ দ্য প্রবলেম?
ছেলেরা তো নাইই বরং মেয়েরাও তার সাথে বন্ধুত্ব করতে ভয় পায়।
একে তো ডিসি ত সাহেবের মেয়ে ।তার উপর গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে যায় আর ক্লাস শেষের আগে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে নেবার জন্য। সাথে আর্দালী থাকে একজন।তার শীতল চাউনিকেও সবাই ভয় পায়। আর্দালী যেন ডিসি সাহেবের থেকেও রাশভারী।
আর তার থেকেও রাশভারী মেয়ে তিন্নি। তার উপর তাকে একলা পাওয়া সেটাও একটা অবাস্তব বিষয়। তাই তাকে আমাদের কেমন তাকে অচেনা জগতের লাগতে থাকে।
না , রহস্যের কোন কুল কিনারা হয়না তাই আমরাও হাল ছেড়ে দিই।
একদিন কমন রুমের পাশে জারুল গাছের নীচে তাকে জারুল কালারের কামিজে দেখে আমি থমকে দাঁড়াই।গাছের জারুল দেখব নাকি তাকে দেখব দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। নিজেকে অসহায় লাগে। সাহস করে কাছে যাই।জারুলের গন্ধ কিম্বা তার পারফিউমের হালকা গন্ধে আবিষ্ট হয়ে যাই। ইচ্ছে করে বলি,
‘তিন্নি, তোমার কি এমন দুঃখ ?’
কিছু একটা বলতে যাব এমন সময় আমার গাধা প্রকৃতির এক বন্ধু ডাক দেয় আমায়। তখন মনে হচ্ছিল একটা লাঠি নিয়ে বাড়ি দিই বন্ধুর মাথায়।
‘শশালাহ টাইম পেলিনা ডাকার?’
ঠিক ঐ মুহুর্তে তিন্নি যেন তার আয়ত চোখ দিয়ে আমায় দেখছিল। কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্ত সেই বুক এফোড়োফোড় করা তাকানোকে পাশ কাটিয়ে আমাকে গর্দভ বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতে হল। ফের অপেক্ষা । কবে আবার মিলবে এমন মোক্ষম সময় যেদিন বন্ধুরা কেউ কাছাকাছি থাকবেনা। মনের অজান্তে আমি কমন রুমের দিকে পাক খেতে লাগলাম।
দিন যায়। জারুল ঝরে যায়। কুর্চি ফোটে তারাও ঝরে যায়। আমিও মেয়েদের কমন রুমের পাশে পাক খাই এক মহাচক্রে।
মেয়েদের মাথায় মনে হয় মাছির মত হাজারটা চোখ থাকে। কি করে জানি তিন্নি টের পায় । কেউ একজন তার জন্যে অপেক্ষা করে।
আদতে আমি অপেক্ষা করি সেই চাউনিটার জন্য। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল।
চোখ দুটি তার কিছু বলতে চাওয়ার আগেই ক্লাসের দুষ্টূ গোত্রীয় বন্ধুরা কেমিষ্ট্রি ল্যাবের পিয়নের সাথে কাঁচা পয়সায় আঁতাত করে লাফিং গ্যাস নেবার প্লান করে ফেলল। আমি যেহেতু কমনরুমকে অক্ষরেখা বানিয়ে ঘুরছি তাই আমি এসব পরিকল্পনার কিছুই টের পেলাম না । ওরা নাইট্রাস অক্সাইডের (N2O) ছোট্ট একটা ড্রাম ম্যানেজ করে ফেলল। কেউ জানেনা এ গ্যাস কিভাবে কাজ করে। শধু শুনে এসেছে । কিন্ত ব্যবহারের পর কি আচরন হয় সেটা কারোর জানা ছিলনা ।
সব মিলিয়ে লাফিং গ্যাস প্রয়োগ করাটাই মোক্ষম মনে করে ওরা সুযোগের সন্ধানে ছিল। একদিন ক্লাস শেষে সবাই বের হবে ঠিক তখনি ওদের কেউ একজন ডাক দিলো,
‘এই তিন্নি শোন’
তিন্নি থমক