এমপি নিক্সনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার চিঠি

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন : সিইসি
বক্তব্য সুপার এডিট হয়েছে : নিক্সন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, স্বতন্ত্র সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) হুমকি ও নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের গালিগালাজ করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা।
ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ডিসি, ইউএনওসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। সম্প্রতি এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছেন ফরিদপুরের ডিসি অতুল সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ইসিতে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
ইসিতে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় সহকারী রিটার্নিং অফিসারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়। এ বিষয় নিয়ে হুমকি, মিথ্যা, মানহানিকর ও অশালীন বক্তব্য দেন স্থানীয় এমপি (স্বতন্ত্র) মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন), চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কাউছার এবং তার অনুসারীরা। তাদের এ আচরণ উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন মর্মে প্রতীয়মান হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে ডিসি অতুল সরকার বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ায় ডিসি অতুল সরকারের কাছে টেলিফোনে কৈফিয়ত তলব করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ার কারণে তার সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় হলে মহাসড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন তিনি।
চিঠিতে আরো বলা হয়, অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিক্সন চৌধুরীর সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ১১ হাজারের বেশি ভোটে জয় লাভ করে। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টার দিকে নির্বাচন-পরবর্তী জনসভায় নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিজয়ী প্রার্থী মো. কাওছার ও এমপি ও তার অনুসারীরা ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েনের কথা উল্লেখ করে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলেন। দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটসহ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অত্যন্ত মানহানিকর এবং অশ্রাব্য ভাষায় হুমকি ও গালিগালাজ করেন। তার অনুসারীরা বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন যা একজন এমপি বা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়।
জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে অত্যন্ত মানহানিকর ও অশোভন উক্তি জেলা পর্যায়ের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের সমন্বয়কারী জেলা প্রশাসনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের জন্য অবমাননাকর। এ ধরনের হীন বক্তব্য স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। তেমনি মাঠ প্রশাসনের সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পথেও চরম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান ডিসি।
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, আমরা জানি, অভিযোগ আছে। অভিযোগটা আমরা সঙ্গে সঙ্গে জেনেছি। কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। করণীয় বিষয় নির্ধারণ করেছি। অবশ্যই যে আচরণ এমপি করেছেন নির্বাচন পরিচালনা করার সময়, সেটা কাম্য নয়। আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। আইনে যেরকম বিধিবিধান আছে, তার ব্যাপারে আইনের বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে। এতটুকু বলতে পারি। আইনে আছে তার বিরুদ্ধে মামলা করা। আপনারা কী মামলা করবেন? যেহেতু নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনি এ কাজ করেছেন।
জবাবে নূরুল হুদা বলেন, এখন আমরা দেখি, যদি মামলা করার বিধান থাকে মামলাই করবো। আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। এ সময় কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আইনে যা আছে, যা যা করা সম্ভব, আমরা সবকিছুই করার জন্য প্রস্তুত আছি।
নির্বাচন হচ্ছে করোনাকালীন সময়ে। আজকেও এক প্রার্থী এলেন শোডাউন করে। তারা স্বাস্থ্যবিধি ও আচরণবিধি মানছেন না। সে জায়গায় আপনাদের করণীয় কিছু আছে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা বলেছি। এগুলো তাদের নিজেদের ব্যক্তি সচেতনার বিষয়। এখানে আমরা অনুরোধ করি। কিন্তু তারা প্রতিপালন করেন না। শুধু তারা কেনো, বাংলাদেশের যেখানেই যায় সেখানেই তো দেখি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করার বিষয়টা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। আমরা তাদের বারবার অনুরোধ করতে পারি, আশা করি তারা মানবে। এ পর্যায়ে তাদের অনুরোধ করা ছাড়া কিছুই করার নেই।
সাংসদ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, মামলার বিধান থাকলে করা হবে। এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। জেলা প্রশাসক সম্পর্কে বক্তব্যের বিষয়ে মুজিবর রহমানের ভাষ্য, সারা দিনের ঘটনা এবং তাঁর অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার, কাউকে জরিমানা করায় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ প্রকাশ যাতে অন্য রকম না হয়, সে জন্য ডিসি সম্পর্কে এভাবে কথা বলেছেন।
চেয়ারম্যান পদের ওই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাওসার হোসেন (নৌকা) নির্বাচিত হন। তাঁকে সমর্থন দেন সাংসদ মজিবুর রহমান। সাংসদের বক্তব্যের বিষয়ে জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের ভাষ্য, বিষয়টি শিষ্টাচারবহির্ভূত। একজন সাংসদের কাছ থেকে এ-জাতীয় বক্তব্য প্রত্যাশিত নয়।
অপরদিকে, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ফোনে গালিগালাজের যে অডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, সেটি বানোয়াট বলে দাবি করেছেন স্বতন্ত্র সাংসদ মুজিবর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন। তাঁর দাবি, বক্তব্যকে ‘সুপার এডিট’ করা হয়েছে। এমন গালিগালাজ তিনি করেননি।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে মুজিবর রহমান এসব দাবি করেন। গত শনিবার অনুষ্ঠিত চরভদ্রাসন উপজেলার উপনির্বাচনে ‘ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে’ এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
মুজিবর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের দিন কেন্দ্রের মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ায় আমাদের এক কর্মীকে গাড়িতে তোলেন ম্যাজিস্ট্রেট। আমি ইউএনওকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানাই। এর বাইরে যে বক্তব্য ছড়ানো হয়েছে, সেগুলো এডিট করা। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।’ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা এসব ছড়াচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেন। চরভদ্রাসনের ইউএনওর সঙ্গে তাঁর ‘মধুর সম্পর্ক’ দাবি করে মুজিবর রহমান বলেন, ‘সংসদীয় আসনের তিন উপজেলার চরভদ্রাসন ও সদরপুরের ইউএনও নারী আর ভাঙ্গার ইউএনও একজন পুরুষ। তাঁদের সঙ্গে ভাই-বোনের মতো সম্পর্ক। তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে এলাকার উন্নয়নে কাজ করছি।’
ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ বলেন, গত শনিবারের উপনির্বাচনের জন্য ২৭ সেপ্টেম্বর চারজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয় জেলা প্রশাসন। নির্বাচনের আগের দিন কেন ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হলো? ইসির কী এ বিষয়ক চিঠি আছে? নির্বাচনের দিন বিজিবি সঙ্গে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটদের মারমুখী আচরণ করতে দেখা গেছে। যেখানে নৌকার ভোট বেশি, সেখানেই ম্যাজিস্ট্রেটরা বেশি তা-ব করেছেন।
শনিবার নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় ফরিদপুরের ডিসি অতুল সরকারকে ‘দাঁতভাঙা জবাব’ দেওয়ার হুমকি দেন সাংসদ মুজিবর রহমান। এ প্রসঙ্গে মুজিবর রহমান বলেন, সারা দিন ম্যাজিস্ট্রেটরা যে তা-ব চালিয়েছেন, তাতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। নেতা-কর্মীরা উত্তেজিত ছিল। প্রশাসনের অনুরোধে তিনি নেতা-কর্মীদের ঠান্ডা করতে গিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে মুজিবর রহমান দাবি করেন, তিনি কোনো আচরণবিধি ভঙ্গ করেননি। যদি আচরণবিধি ভেঙে থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হবে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরের দিন সকাল ১০টার দিকে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ইউএনও আমার ভাঙ্গার বাড়িতে যান। নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইউএনও কোনোভাবেই আমার বাড়িতে আসতে পারেন না। জেলা প্রশাসকও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।’


বিজ্ঞাপন