বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

আরও ২৪ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ২২৫২

 

বিশেষ প্রতিবেদক : করোনাতে আক্রান্ত জটিল রোগীর সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। সরকারি হাসপাতালের প্রায় সব বেডে রোগী রয়েছেন, ফলে অনেককেই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন। আইসিইউ না পেয়ে রোগী মারা যাবার ঘটনাও ঘটছে আগের মতো। চিকিৎসকরা বলছেন, একটি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে নির্ধারিত হাসপাতালের ওয়ার্ডের রোগী পাঠানোর ‘কল’এর পাশাপাশি হাসপাতালের বাইরে থেকেও অনুরোধ আসছে অনেক। যে কারণে বলতেই হচ্ছে, ‘দুঃখিত, বিছানা খালি নেই’।
আর ঢাকার বাইরের আইসিইউ ফাঁকা কেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইসিইউ বিশেষজ্ঞ বলেন, মফস্বলের মানুষের ধারণা, সেখানকার হাসপাতালের চেয়ে ঢাকায় এলে বেটার ম্যানেজমেন্ট, ওষুধ, যন্ত্রপাতি, সিনিয়র চিকিৎসকসহ ঢাকার আইসিইউগুলোতে সুযোগ সুবিধা বেশি। যার কারণে তারা সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে ঢাকায় আসার প্রবণতা বেশি।
সুরাইয়া বেগমের বয়স ৬৫ বছর। করোনাতে আক্রান্ত সুরাইয়া বেগম বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে নয়টাতে মারা যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতে।
গত ১০ থেকে ১২ আগে করোনায় আক্রান্ত হবার পর তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় কুলিয়ে উঠেতে না পেরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হন তিনি। সুরাইয়া বেগম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা লিমার আত্মীয়।
ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হয়েও আমি এ হাসপাতালের আইসিইউতে একটা বেড ম্যানেজ করতে পারিনি, কারণ বেড ফাঁকা নেই। গত দু তিন ধরে আইসিইউর জন্য চেষ্টা করছিলাম, পারিনি ম্যানেজ করতে ।
প্রচুর রোগী বেড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কেবল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজেই প্রায় ৩০ থেকে ৩১ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
দেশের প্রথম করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, এ হাসপাতালে আইসিইউ বেড রয়েছে ১৬টি, সবগুলো বেডে রোগী আছেন। আর পাশাপাশি বেড়েছে বেডের জন্য রিকোয়েস্টের চাপ। একইসঙ্গে আইসিইউতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর’ সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গতমাস থেকে এটা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আইসিইউতে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডেও রোগী অনেক বেশি, প্রায় ফুল। ওয়ার্ড থেকে আইসিইউতে রোগী শিফটিং-এর হারও বেড়েছে।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় আছে । যেগুলো হচ্ছে, ওয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকেই আইসিইউর রিকোয়েস্ট বেশি থাকছে, আবার হাসপাতালের বাইরে থেকেও আইসিউর জন্য অনুরোধ আসছে অনেক বেশি, কিন্তু সেটা দেওয়া যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অধিদফতর ৩ ডিসেম্বর জানানো হয়েছে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা যথাক্রমে ১৬ শয্যা, ১০ শয্যা, ১০ শয্যা ও ১৬ আইসিইউ শয্যার প্রতিটি শয্যায় রোগী রয়েছে। আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ২২ জন, ফাঁকা রয়েছে দুইটি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১১ জন, ফাঁকা রয়েছে চারটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১১ জন, ফাঁকা রয়েছে পাঁচটি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন দুইজন, ফাঁকা রয়েছে চারটি। আবার তালিকা থাকে সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর তালিকা দেখানো হয়েছে শূন্য।
বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালের সাত আইসিউ শয্যার মধ্যে রোগী আছে সাতজন, আসগর আলী হাসপাতালের ৩১ শয্যাতে রোগী আছেন ২৬ জন, স্কয়ার হাসপাতালের ২৫ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৯ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালের ছয় শয্যার মধ্যে রোগী আছেন পাঁচজন, ইউনাইটেড হাসপাতালের ২২ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৪ জন, এভার কেয়ার হাসপাতালের ২০ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৯ জন, ইম্পালস হাসপাতালের ৫৬ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৩ জন, এ এম জেড হাসপাতালের ২১ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৩ জন ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ১২ শয্যার মধ্যে ১২টিতেই রোগী আছেন। অর্থাৎ, ঢাকা মহানগরীর অধিদফতরের তালিকাতে থাকা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ রয়েছে ৩১৬টি, যার মধ্যে রোগী আছেন ২২৬ জন আর শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৯০টি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০টি হাসপাতালের ৩৯টি বেডের মধ্যে রোগী আছেন ১৬ জন আর ফাঁকা রয়েছে ২৩টি। সারা দেশের অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ রয়েছে ২১৯টি যাতে রোগী আছেন ৯২ জন আর ফাঁকা রয়েছে ১২৭টি।
সারাদেশে অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ রয়েছে ৫৭৪টি আর তাতে ভর্তি আছেন ৩৩৪ জন, শয্যা ফাঁকা রয়েছে ২৪০টি।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম বলেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শুরু থেকেই আইসিইউর চাহিদা ছিল অনেক, মাঝের কিছুদিন সহনীয় অবস্থায় এসেছিল, ওয়ার্ডের রোগীর সংখ্যা কমেছিল কিন্তু আবার আগের মতো অবস্থা শুরু হয়েছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে একদিনও একটা শয্যাও ফাঁকা থাকেনি, যখনি সেটা ফাঁকা হয়েছে তখনই রোগী নিতে হয়েছে। সারাদিন একটা বেড শূন্য ছিল এটা এখনও হয়নি এ হাসপাতালে। কিন্তু তখন ওয়েটিং যে লিস্টটা সেটা ছোট হয়েছিল।
তিনি বলেন, গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেই ওয়েটিং লিস্ট বড় হতে শুরু করেছে, অনেক বড় ওয়েটিং লিস্ট একটা আইসিইউ বেডের জন্য, আমাদের ওয়েটিং লিস্টের খাতাতে একটার পর একটা রোগীর নাম যোগ হচ্ছে।
ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ওয়ার্ড থেকে যখন আইসিইউর জন্য ‘কল’ হচ্ছে, ‘ওয়েটিং লিস্টে’ থাকা রোগীদের স্বজনদের বলছি, ‘দুঃখিত বিছানা খালি নেই’। সঙ্গে এও বলে দিচ্ছি, যদি রোগীর ওয়েট করার মতো অবস্থা যদি না হয় তাহলে আপনারা অন্য হাসপাতালের আইসিইউ ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা দেখেন, যোগাযোগ করেন। কারণ আমরা তো তাদের বলতে পারছি না কবে একটা বেড খালি হবে আর কবে সেই রোগীকে আইসিইউতে নিতে পারবো। আর ততক্ষণে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। কারণ আইসিইউতে যে রোগীর জন্য কল দেওয়া হচ্ছে, ওয়ার্ডে তাকে অক্সিজেন দিয়ে পারা যাচ্ছে না বলেই আইসিইউতে কল দিচ্ছে। সেখানে যদি তাকে আরও অপেক্ষা করতে হয় সেতো পারবে না। ফলাফল হিসেবে যা হবার তাই হচ্ছে।
আইসিইউর জন্য ওয়েটিং লিস্টের তালিকাটা কত বড় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৩ থেকে ১৬ জন রোগীর কলও পাচ্ছি আমরা একদিনে। এই যদি হয় কলের অবস্থা, কিন্তু বেড খালি হলে তো একটা অথবা নিদেনপক্ষে দুইটা হতে পারে। তাহলে এতজন রোগীকে আমি কোথায় পাঠাবো, তাকে অ্যাকোমোডেট করার কোনও ব্যবস্থা নাই।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একইসঙ্গে এই হাসপাতালের ওয়ার্ড ছাড়াও বাইরে থেকে অনেক অনুরোধ থাকে আইসিইউ শয্যার জন্য। কিন্তু আমরা তো আমাদের রোগীকেই নিতে পারছি না, বাইরের রোগীদের কিভাবে নেব? আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেকেই খরচ চালাতে পারেন না, তাই সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর চাহিদা অনেক বেশি।
এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, ৩ ডিসেম্বর তাদেরকে করোনা রোগী সুস্থ হবার ‘ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল’ করার পরই দ্রুত তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ বলেন, যখন সংক্রমণ বাড়ে তখন সংক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যাও বাড়ে। তাই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আইসিইউতে ওয়েটিং লিস্টের তালিকা বড় হচ্ছে দিনকে দিন। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২জন, কোনও কোনও দিন এরচেয়েও আইসিইউ বেডের জন্য কল পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু বেড পাওয়া যাচ্ছে না।
করোনায় আরও ২৪ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ২২৫২ : করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ২৪ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২০ ও নারী ৪ জন। সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৬ হাজার ৭৭২ জনে।
শুক্রবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৮টি ল্যাবরেটরিতে ১৫ হাজার ৫২৭টি নমুনা সংগ্রহ ও ১৫ হাজার ৪৩০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়াল ২৮ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪১টি। এ সময়ে করোনা আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হন আরও দুই হাজার ২৫২ জন। দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯১ জনে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৫৭২ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৫১ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক শূন্য ৫৯ শতাংশ। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ, শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮২ দশমিক ৪৮ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৩ শতাংশ।
দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু ৬ হাজার ৭৭২ জনের। তাদের মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ১৮৪ (৭৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ) ও নারী এক হাজার ৫৮৮ জন (২৩ দশমিক শূন্য ৪৫ শতাংশ)।
মৃতদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টায় মৃত ২৪ জনের মধ্যে শূন্য থেকে বিশোর্ধ্ব একজন, ত্রিশোর্ধ্ব দুইজন, চল্লিশোর্ধ্ব দুইজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব দুইজন এবং ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ১৭ জন রয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত ২৪ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৪ জন, চট্টগ্রামে দুইজন, রাজশাহীতে একজন, বরিশালে দুইজন, সিলেটে একজন, রংপুরে একজন এবং ময়মনসিংহে তিনজন।


বিজ্ঞাপন