ঝিনাইদহর বারোবাজারের ইতিহাস

অন্যান্য বিবিধ সাহিত্য

কাজি আরিফ : খৃষ্টের জন্মের ৩ শত বছর পূর্বে আলেকজান্ডার পৃথিবীর অধিকাংশ রাজ্য জয় করে ভারত বিজয়ের উদ্দেশ্যে কাবুল হয়ে ঝিলাম নদী পার হয়ে পাঞ্জাব পর্যন্ত আসেন। তার সৈনিকরা তখন রণক্লান্ত। সেখানে উনিশ মাস অবস্থান করেন এবং আশেপাশের রাজ্য সমূহ জয় করেন। তক্ষশীলার রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করেন।


বিজ্ঞাপন

আলেকজান্ডার খবর নিয়ে জানতে পারেন যে গঙ্গার উপকূলবর্তী এলাকায় মহাপরাক্রমশালী এক রাজ্য আছে যার অধীনে অসংখ্য হাতি,ঘোড়া ও যোদ্ধা আছে আলেকজান্ডার বা তার ঐতিহাসিকরা তার নামকরন করেছিলেন গ্রিস ভাষায় ‘গঙ্গারিডি’ অর্থাৎ গঙ্গা তীরের জনবসতি।গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল গঙ্গা তীরবর্তী ‘গঙ্গে’। এই ‘গঙ্গে’ নগরী ছিল একটি প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক বন্দর। গঙ্গে বন্দরের সঙ্গে রোম, মিসর, চীন, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার তেজারতি সম্পর্ক ছিল।সেখানকার তৈরি সূক্ষ মসলিন ও প্রবাল রত্নাদি পশ্চিম দেশে রফতানি হত। তাদের মতো পরাক্রান্ত ও সমৃদ্ধ জাতি ভারতীয় উপমহাদেশে আর ছিলনা।


বিজ্ঞাপন

সকলের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গ্রেট আলেকজান্ডার গঙ্গা অতিক্রম করে গঙ্গারিডি জয় করার বাসনা ত্যাগ করেই গ্রিসে ফিরে যেতে চান এবং পথিমধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। তার আর নিজ মাতৃভূমি গ্রিসে ফেরা হয়নি।
এই যে ‘গঙ্গারিডি’ নামে যে রজ্যের কথা তৎকালীন ঐতিহাসিকদের লেখায় পাওয়া যায় এর অবস্থানের ব্যাপারে ঐতিহাসিকগন তিনটি স্থানের সাথে মোটামুটি সাদৃশ্য পান। একটা হল কোটালীপাড়া বরিশাল, একটা হল যশোর-ঝিনাইদহর বারোবাজার আরেকটি হল পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলা।

বারোবাজারে নাকি গঙ্গারিডির রাজধানী ছিল এবং এর সপক্ষে অনেক স্বাক্ষী সাবুদ আছে । জানা যায় বারোবাজার এলাকা নাকি দুই হাজার বছর আগে এক আলোকোজ্জ্বল শহর ছিল।
একসময় এখানে নাকি সামুদ্রিক বন্দর ছিল, জাহাজঘাটা নামক একটি স্থান এখনো সেখানে আছে যা প্রমান করে এখানে একদা বন্দর ছিল যেখানে জাহাজ এসে ভিড়ত।

আজ বারোবাজার ভ্রমন নিয়ে বলছি।
২০১৮ সালের কোন একদিন বেশ ভোরবেলা মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বাসা থেকে বেরোলাম ।

উদ্দেশ্য , বারোবাজার এলাকায় পুরাকীর্তির স্থান সমূহগুলো দেখব।
রোজাকে বললাম , চলো যাই। যশোর শহর থেকে সম্ভবত ১৪ কিমি দূরে এই বারোবাজার।

যশোর বা ঝিনাইদহ-কালিগঞ্জের বারোবাজার এলাকার একটা ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। যা পঞ্চদশ শতাব্দীর।

আর খৃষ্টপূর্ব সময়ে যে ইতিহাস আছে তাতো বললাম ই।

১৯৬১ সালের দিকে এই অঞ্চলে বড় ঢিবি নামে পরিচিত কয়েকটি স্থান সমুহ খুড়ে আবিস্কার করেছিল কয়েকটি মসজিদ। তারপরে বিষয়টা আর এগোয়নি। কিন্ত অনেক বছর পর পরবর্তিতে ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্বিক বিভাগ বারোবাজার এলাকা খুঁজে ও খনন করে আনে আরো অনেকগুলো মসজিদ , রাজপ্রাসাদের ভগ্নাংশ, দীঘি ।
মসজিদ্গুলোর স্থাপত্যরীতি দেখে মনে হয়েছে এগুলো পঞ্চদশ শতাব্দীতে বা তার কিছু আগে এসব মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।কেননা স্থাপত্য রীতিতে সুলতানী-মোঘল- তোঘলোকি রীতি লক্ষনীয়। তবে সবচে যে বিষয়টি সবচে প্রচলিত আছে তা হল, পঞ্চদশ শতাব্দীতে খানজাহান আলী বা তার অনুসারীরা এই এলাকায় হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে এখানে অনেক মসজিদ নির্মান করেন এবং অসংখ্য দীঘি খনন করেন।

খানজাহান আলী আকবরের সময়ে একজন দক্ষ সেনাপতি ছিলেন যিনি পরে একজন আলেম-বুজুর্গ ব্যক্তিতে পরিনত হন। তিনিই এই বারোবাজার থেকে খুলনা হয়ে বাগেরহাট পর্যন্ত অসংখ্য মসজিদ নির্মান করেন আর অসংখ্য দীঘি খনন করেন।তার অনেক কীর্তি যশোর খুলনার যাত্রাপথে দেখা যায়।

এই বারোবাজার এলাকায় দীঘির সংখ্যা ছয় কুড়ি ছয় টা ( ১২৬ টি)।
বারোবাজারকে মসজিদের শহরও বলা হয়। মসজিদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ধরা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভূমিকম্পের কারনে এসব স্থাপনাগুলো মাটির নীচে চাপা পড়ে যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়।

আমরা গোড়ার মসজিদ, পাঠাগার মসজিদ, পীরপুকুর মসজিদ জোড় বাংলা মসজিদ,গলাকাটা মসজিদ ও গাজিকালু চম্পাবতীর মাজার দেখলাম।

এসব দেখতে দেখতে মেয়ের স্কুল ছুটির সময় হয়ে এলো বলে ফিরে এলাম। পুরো এলাকা, রাজবাড়ি এসব দেখা হলনা যা রেখে দিলাম পরবর্তিতে দেখব বলে।

খারাপ লাগা বিষয় হল, এসব মসজিদ বা প্রত্নতাত্বিক স্থান সমূহের সঠিক রক্ষনাবেক্ষন নেই।এগুলো মসজিদ হিসাবে বেশিরভাগ চলমান রয়েছে যেখানে সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থাই নেই।
ইতিহাস ও প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা সমূহ সংরক্ষনের ব্যাপারে আমরা চরম উদাসীন।

পারলে এসব প্রত্নতাত্বিক স্থাপনার ইট খুলে নিয়ে ঘরের বা টাট্টিখানার সিড়ি বানাই আমরা ( দেখেছি আমি) !! আজব জাতি আমরা । এক সময় এসব ইতিহাসের স্বাক্ষী কিছুই খুজে পাওয়া যাবেনা আর ।