লকডাউনের প্রথম দিন : সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিএনজি

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাত দিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। মুখে লকডাউন বলা হলেও শর্তসাপেক্ষে নিয়ন্ত্রিত চলাচলই সেই নির্দেশনায় উল্লেখ করা আছে। সেই অনুযায়ী থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এসব বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।
লকডাউনে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সড়কে যাত্রীরা বিপাকে থাকার সুযোগ লুফে নিচ্ছেন অটোরিকশা চালকরা। যাত্রীদের কাছে তারা হাঁকাচ্ছেন দ্বিগুণ ভাড়া। যাত্রীরাও দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েই যাচ্ছেন গন্তব্যে। কারণ সাধারণ যাত্রীদের চলাচলে সড়কে নেই গণপরিবহন (বাস)। এদিকে সকালে দেখা গেছে মিনি পিকআপ ও লেগুনায়ও যাত্রীরা চলাচল করছেন।
লকডাউনের প্রথম দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাঘুরে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি প্রয়োজনে চলাচল করার নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না চালক ও যাত্রীরা। নিরাপত্তার জন্য যাত্রীরা সিএনজি অটোরিকশায় যাতায়াত করতে চাইলেও চালকরা একই সঙ্গে দুই যাত্রী নিচ্ছেন।
এদিকে সড়কের পাশে কম সংখ্যক হলেও রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চালকদের যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদের অনেক মুখে মাস্ক ছিল না। বিশেষ করে লকডাউন কার্যকরি করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা প্রশাসনের কাউকে দেখা যায়নি। ফলে মানুষ কারণে অকারণে ছুটছে লাগামহীনভাবে।
সকালে প্রেসক্লাব এলাকায় টিসিবিরপন্য বিক্রয় ট্রাকের কাছে গিয়ে দেখা গেছে, মানুষ একজনের সাথে আরেকজন মিশে দাঁিড়য়েছিল। অনেকের মুখে মাস্কও ছিল না।
এদিকে, লকডাউনের জন্য শেয়ারবাজারে লেনদেনের সময়ও ২ ঘন্টা কমিয়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত করা হয়েছে। সল্প সময়ের লেনদেনের প্রথম দিনে আজ সূচকের ঊর্ধ্বমূখী প্রবণতা দেখা গেছে। দেশের প্রধান শেয়াবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এদিন সূচকের পাশাপাশি বেড়েছে বেশিরভাগ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার দর। ডিএসইতে এর আগে টানা দুই কার্যদিবস পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। তৃতীয় কার্যদিবসে এসে ঊর্ধ্বমূখী ধারায় ফিরলো এক্সচেঞ্জটি। সোমবার সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে লেনদেন শেষে ডিএসইতে এমন চিত্র দেখা যায়।
দেখা যায়, ডিএসই ব্রড ইনডেক্স এদিন ৮৮ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ৫ হাজার ১৭৭ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১৬ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৮২ পয়েন্টে এবং ডিএসই–৩০ সূচক ৪৩ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৪৪ পয়েন্টে।
এদিন লেনদেন হওয়া ৩২১টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৩১টির, দর কমেছে ১৪টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৭৬টির। আলোচ্য দিনটিতে টাকার অংকে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২শ’৩৬ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
লকডাউনের শুরুতে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে শাক-সবজির সহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও ক্রেতা নেই দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল কাওরান বাজার ও হাতিপুল বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
বিক্রেতারা জানান, লকডাউনের ঘোষণা আগে থেকে আসায় মানুষ গত দুই দিন প্রচুর পরিমানে শাক-সবজিসহ নিত্যপণ্য কিনে নিয়েছে। এতে বাজারের এখন নিত্য পণ্য থাকলেও ক্রেতা নেই বললেই চলে।
এদিকে সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ঔষধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়, চিকিৎসাসেবা মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় কেবল খাদ্য বিক্রয় ও সরবরাহ করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খাওয়া যাবে না।
এছাড়া শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। তবে দোকানগুলো পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাবস্থায় কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং অন্য কোনো শহরে যেতে পারবে না।
কাঁচাবাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
কাওরান বাজারে সরেজমিন এসে দেখা যায় উল্টো চিত্র। কাঁচাবাজারে বিক্রেতাদের অনেকের মুখে নেই মাস্ক। ক্রেতাদের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মানার বলাই নেই। এ প্রসঙ্গে কথা হয় কাওরানে বাজারের সবজি বিক্রিতা রাজুর সাথে। তিনি বলেন, গরমে মাস্ক ভিজে গেছে। হকার এলে আরেকটা কিনে নিবেন। গত কয়েকদিন বাজারে ক্রেতা থাকলেও কালকে যে মাল আসছে তা এখন বাজারে পড়ে আছে খুচরা বিক্রেতা নেই। একই সঙ্গে এখানে যারা পাইকারী সবজি কিনে তারাও খুব একটা মাল কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেনা।
শুধু রাজুই নয়, তার মতো বাজারে তিনলাই ধনেপাতা নিয়ে বসে আছেন মুন্সিগঞ্জের জাভেদ হোসেন, তিনি বলেন, আমরা পাইকারি ব্যবসা করি কিন্তু আজকে বাজারে মানুষ বেশি একটা নাই তাই বেলা ১১টায় এগুলো বিক্রি হয়নি। অন্যদিন হলে ৭টার আগেই এসব বিক্রি হয়ে যেত।
এদিকে রাজধানীর কয়েকটি সড়ক ও মহল্লা ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল করছে। তবে খুব একটা যানজট নেই। রাস্তায় গণপরিবহনে মধ্যে বাস ছাড়া সবধরনের যানবাহন চলছে। পাড়া-মহল্লায় দোকানপাট খুলেছে। তবে প্রধান সড়কের মোড়ে চা দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে।
রাইড শেয়ারিং বন্ধ থাকলেও অনেক বাইকার রাস্তায় দর কষাকষি করে যাত্রী তুলেছেন। যদিও মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন নিষেধ করেছে সরকার।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এই নির্দেশনা জারি হয়েছে। এটি পালন করা গেলে হয়তো করোনা মহামারি থেকে এ যাত্রা রেহাই পাবো।
আবার সিএনজি অটোরিকশা চালকরা বেশি ভাড়া পাওয়ার আসায় শেয়ারিং করেও যাত্রী নিচ্ছেন। হাতের ফ্র্যাকচারের সমস্যাজনিত কারণে মহাখালীতে চিকিৎসকের কাছে যাবেন আনোয়ার হোসেন।
তিনি উত্তরা আজমপুর মোড়ে সিএনজি অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। একটি সিএনজি অটোরিকশা ঠিক করলেন। পরে চালক বলছেন, আরও একজন যাত্রী নিতে হবে। পরে আনোয়ার উঠে বসলেন। চালক মহাখালীর আরও একজন যাত্রী নিয়ে তবেই রওয়ানা হলেন গন্তব্যে।
উত্তরা আজমপুর থেকে মহাখালী পর্যন্ত চালক ভাড়া চেয়েছিলেন ৪শ টাকা। যাত্রী আনোয়ার ২শ টাকায় যাবেন বলে জানান। এরপরই চালক বলেন আরও একজন যাত্রী নিতে হবে। তারপর আরও ২শ টাকা ভাড়া চুকিয়ে দু’জনকে ৪শ টাকায় নিয়ে মহাখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
এ বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, লকডাউনে পড়েছি বিপদে। কিন্তু সিএনজি অটোরিকশা চালকরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। ভাড়া দ্বিগুণ দিয়ে যেতে হবে। অটোরিকশা শেয়ারিং করেই যেতে হচ্ছে।
আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে থাকা সিএনজি অটোরিকশা চালক রশিদ জানান, ভাই, বেশি ভাড়ায় যাত্রীরা যেতে চায় না। তাই একই জায়গার দুই যাত্রীকে নিয়ে যাচ্ছি। এতে আমাদের লাভ হচ্ছে আবার যারা গাড়ি পাচ্ছে না তারাও যেতে পারছে। যার যার ভাড়া সে সে দেবে।
সিএনজি অটোরিকশা চলাচলে পুলিশি কোনো বাধায় পড়েছেন কিনা জানতে চাইলে এই চালক বলেন, সড়কে কোথাও পুলিশের বাধা নেই। কেউ এখন পর্যন্ত থামায়নি।
প্রজ্ঞাপনে দেওয়া নির্দেশনাগুলো হলো:
১. সব ধরনের গণপরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে, পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা, জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া, বিদেশগামী/বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।
২. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন-ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহের (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্র) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে।
৩. সব সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস কেবল জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে। শিল্প-কারখানা ও নির্মাণ কার্যাদি চালু থাকবে। শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক শিল্প-কারখানা এলাকায় নিকটবর্তী সুবিধাজনক স্থানে তাদের শ্রমিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল/চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় কেবল খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ করা যাবে। কোনও অবস্থাতেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ করা যাবে না।
৫. শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। তবে দোকানে পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাবস্থায় কর্মচারীদের মধ্যে আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কোনও ক্রেতা সশরীরে যেতে পারবে না।
৬. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
৭. ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
৮. সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকায় সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৯. সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে।
১০. এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


বিজ্ঞাপন