ফাঁকা হচ্ছে ঢাকা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী

বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের হাহাকার

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সময়ে জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে করোনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। কিন্তু এতেও জনগণের উদাসীনতা কমেনি। এ অবস্থায় জনস্বার্থে সরকার আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের বিষয়ে সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা করছে।
এদিকে লকডাউনের খবরে ঘরমুখো মানুষের চাপের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। গতকাল ভোর থেকে গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে শহীদনগর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়।
দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। প্রচ- গরমে যানজটে আটকেপড়া মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। এ সময় অনেককে প্রচ- রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, করোনার দ্রুত সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। অনেকে ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই বাড়ি ফিরছেন ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ট্রাক, পিকআপে করে। এসব ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ থাকায় এই যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
মনোহরগঞ্জর উপজেলার কচুয়া গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. আলম জানান, সকাল ছয়টায় যাত্রাবাড়ি থেকে রওনা হন তিনি। সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি দাউদকান্দির গৌরীপুরে পৌঁছেছেন। ৫০ কিলোমিটার পথ যেখানে এক ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া যায়, সেখানে আজ সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে।
পরিবহনের বাসচালকরা বলেন, ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সড়ক যেতে এক ঘণ্টার বদলে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগছে। অসংখ্য যানবাহন একযোগে মহাসড়কে বের হওয়ায় এই যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। দাউদকান্দি হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আলিমুল আল রাজী বলেন, অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল ও সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানজট নিরসনের চেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, জরুরি সেবা-পণ্য ছাড়া বাকি সব কিছুই বন্ধ থাকবে এই লকডাউনে। চার দিন পর থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের সময় আবারও বাড়ানো হবে কিনা সে বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে গুঞ্জন চলছে। সরকারিভাবে এমন প্রজ্ঞাপন দেয়ার আগেই এমন কিছু অজানা শঙ্কা নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন হাজারো মানুষ।
রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের বাড়তি চাপ দেখা গেছে। কেউ ঢাকা ছাড়ছেন পণ্যবাহী যানবাহনে, কেউবা পায়ে হেঁটে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়লে ২৩ মার্চ প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা করেছিল সরকার। ওই সময় সব অফিস আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরণের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
করোনার সংক্রমণ কমে আসায় আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে থাকে। মার্চের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে ভাইরাসটির বিস্তার রোধে সারাদেশে গত ৫ এপ্রিল থেকে সরকার ঘোষিত সাত দিনের বিধিনিষেধ শুরু হয়।
বিধিনিষেধের কারণে মানুষের কাজ ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের প্রতিটি সিটি এলাকায় যান গণপরিবহন চালু এবং শুক্রবার থেকে দোকানপাট ও শপিংমল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এমন অবস্থার মধ্যে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউন দেয়ার চিন্তা করছে সরকার।
কঠোর লকডাউন দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, ঘোষিত লকডাউনের সময় জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। এছাড়া যানবাহন চলাচল, কলকারখানা ও পোশাক কারখানাও বন্ধ থাকবে।
গতকাল ঢাকার আমিনবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা ছেড়ে যেতে মানুষের বাড়তি তোড়জোড়। আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা ছাড়তে নগরবাসী যে যার মত পথ খুঁজে নিয়েছেন। কেউ ঢাকা ছাড়ছেন পণ্যবাহী পিকআপ ভ্যান ও মিনি ট্রাকে, কেউ যাচ্ছেন পায়ে হেঁটেই। পরিস্থিতি দেখে কিছুটা ঈদের আগ মুহুর্তের অবস্থা মনে হলেও এটি নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা নয়, যারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন তারা মূলত লকডাউনের শঙ্কায় নগর ছেড়ে যাচ্ছেন।
বাড়িমুখো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই দিনমজুর শ্রেণির। আসছে লকডাউন কঠোর হলে তাদের ঢাকায় থাকা কষ্টকর হতে পারে। কর্মহীন হওয়ার এমন আশঙ্কায় তারা আগে থেকেই গ্রামের পথে রওনা হয়েছেন।
ঢাকা ছেড়ে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন রাসেল মিয়া। আমিনবাজার কথা হয় তার সঙ্গে। শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘লকডাউন দিছে, ঢাকায় থাইকা কি করুম? বাড়ি যাই। গাড়ি তো বন্ধ। পিকআপে কইরা চন্দ্রা মোড়ে যাই। যাইয়া দেখি গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।’
শুধু দিনমজুরই নন, ছিন্নমূলদের মধ্যে বিভিন্ন ছোট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এবং ছোট ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হয়েছেন ঢাকা ছাড়ার মিছিলে।
ঢাকার মিরপুরের তুলা ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান জানান, চলমান কঠোর স্বাস্থ্যবিধিতে তার ব্যবসা বন্ধ। সামনের লকডাউনে ব্যবসা হবে আশা করতে পারছেন না তিনি। তাই আগে থেকেই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।
আনিসুর রহমান বলেন, এখনি ব্যবসা নাই। এইখানে থাইকা লাভ কি? দোকান ভাড়া পকেট থেকে দিতাছি। খাওয়া খরচ। বাসা ভাড়া সবই বেশি। বাড়ি গেলে খাওয়া খরচ আর বাকি বাড়তি খরচগুলো তো বাঁচবে।
মোহাম্মদপুর থেকে পিকআপ ভ্যানে করে ময়মনসিংহের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন গেসু মিয়া। তিনি জানান, প্রতি বছর ঈদের আগে সবাই মিলে বাস ভাড়া করে তারা গ্রামের বাড়িতে যান। এবারের ঈদের বিষয়টি তাদের মাথাতেই আসছে না। বরং লকডাউনে কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত তারা।
ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলো জানান, দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙে বাড়ির পথে যেতে হচ্ছে তাদের। এতে বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে তাদের।
কথা হয় রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার আমেনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি মানুষের বাসায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শিশু সন্তানও রয়েছে তার। বছর খানেক আগে স্বামী তালাক দেওয়ায় এখন নিজেই উপার্জন করেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে বর্তমানে কাজও কমে গেছে। সামনে আসছে আরো কঠোর লকডাউন। তাই থাকা ও খাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে রোজিনার। ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাড়ি আমেনা জানান, কোনো আয় নেই। জীবন চলছে অন্যের দয়ায়। কেউ দিলে খাবার জোটে, না দিলে জোটে না। এভাবেই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটছে।
শুধু আমেনাই নন, বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দিন যত গড়াচ্ছে, রাজধানীজুড়ে থাকা এসব মানুষের হাহাকার ততই বাড়ছে। লকডাউনের কারণে ফের বিপাকে পড়তে যাচ্ছে দেশের নি¤œ আয়ের মানুষ। বিশেষ করে শহরে বসবাসরত দিনমজুর ও নি¤œ আয়ের মানুষদের মাঝে রোজগার নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন লকডাউনের সময় বাড়লে তাদের দুর্দশা আরো বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আবার যারা শহরে থেকে যাচ্ছেন তারাও অনিশ্চয়তার প্রহর কাটাচ্ছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নি¤œ আয়ের মানুষদের সাথে কথা বললে এমন হতাশার চিত্র উঠে আসে। রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন রবিউল হোসেন। করোনার আগে যা আয়-রোজগার হতো তাতে ভালোভাবেই চলত তার সংসার। কিন্তু করোনায় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। করোনায় প্রথম লকডাউনে চরম দুর্দশার পর পরবর্তীতে আবারো রোজগার শুরু করেন। রোববার সকালেও চা বিক্রি করছিলেন তিনি।
লকডাউনের কথা বললে আফজাল বলেন, আগেরবার কোনোমতে দিন পার করছি। এবার আর উপায় নাই। তাই বিকালে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাব। তিনি আরো বলেন, লকডাউন বাড়লে ঢাকায় না খাইয়া থাকা লাগব।
আফজাল হোসেনের মতো একই অবস্থার কথা জানান রিকশাচালক জুম্মন। চাঁদপুর থেকে এসে রামপুরা এলাকায় রিকশা চালান তিনি। গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তার। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঢাকা ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন এই রিকশাচালক।
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে পরিবহন খাতে যারা বাস, মিনিবাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার বা হেলপার হিসেবে কাজ করেন তারা মজুরি পান প্রতিদিনের ট্রিপ বা যাতায়তের ওপর। ইতিমধ্যেই যাত্রী ও যাতায়াত দুটিই কমে যাওয়ায় তাদের আয় অনেক কমে গেছে।
দ্বিতীয় দফায় লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে মালিকরা তাদের কোনো মজুরি দেবে কি না তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া অটোরিকশা ও রাইড শেয়ারিংয়ে যারা কাজ করেন তারাও চিন্তিত।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। যারা দিন আনে দিন খায়। তার ওপর রয়েছেন নি¤œ আয়ের মানুষেরা। করোনায় শুধু তারাই নন, যারা চাকরিজীবী নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সবাই সংকটে আছেন। দ্বিতীয় দফায় লকডাউনে সেই সংকট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা কোয়ালিশন ফর আরবানের নির্বাহী খন্দকার রেবেকা সানইয়াত বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তারা আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে, বিদেশ থেকে সাহায্যও পাচ্ছে। অনেক এনজিও তাদের সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু এ দেশের ছিন্নমূল মানুষ রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে। অতি কষ্টে ছিন্নমূল মানুষ জীবনযাপন করছে। বর্তমানে রাজধানীর ছোট-বড় বস্তিগুলোতে ৩৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে ছিন্নমূল মানুষ রয়েছে অন্তত দুই লাখ। দীর্ঘসময় দুবার লকডাউনের মধ্যে পড়ে তারা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে করোনায় প্রতিদিনই শনাক্ত বাড়ছে, বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। এটি অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। কাজ হারিয়েছে লাখো মানুষ। চাকরিজীবী-শ্রমজীবী সবার আয় কমেছে। নিরুপায় হয়ে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন।


বিজ্ঞাপন