কাজী আরিফ
জোছনা রাত। শাঁই শাঁই করে গাড়ি ছুটে চলছে পাশের রাস্তায়।
রাস্তার একদিকে সুউচ্চ ইমারত বিশেষ করে সব ফাইভ স্টার হোটেল, মার্কেট। অনতিদুরে আলবার্ট হল। তার থেকে আরো এক কিলোমিটার গেলে বাকিংহাম প্যালেস। যেখানে কুইন এলিজাবেথ থাকেন। রাস্তার আরেক মাথায় লন্ডনের বিখ্যাত অক্সফোর্ড স্ট্রিট। পৃথিবীর সমস্ত ব্রান্ডের দোকান ওখানে বলেই পর্যটকের ভিড়টা বেশী।
রাস্তার অপর পাশে বিখ্যাত হাইড পার্ক।
রাতে ডিনারের পর আমি ঠান্ডা উপেক্ষা করে একটু নির্জনতার জন্য হাইড পার্কে এসেছি । মাথার উপর চাঁদ। মেঘ মেঘ আকাশে মাঝে মাঝে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। দারুন একটা জোছনা দুষ্ট বালিকার মত উঁকিঝুঁকি মারছে ।ভালই লাগছে।
লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে ।কেউ কেউ হেঁটে পার্ক ক্রস করে পথ পাড়ি দিচ্ছে । আমি ‘আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল’ করে ,একটু নিসর্গ উপভোগ করে আমার ‘হোটেল হিলটনে’ ফিরব। এই হোটেলটাও বিখ্যাত। আমি স্টেট গেস্ট হিসাবে ভিভিআইপিদের সাথে এই হোটেলে একটু জায়গা পেয়েছিলাম। সে গল্প ভিন্ন গল্প।
পার্কের দিক থেকে আমি এপাশে আসব। দৌড়ে রাস্তা পার হওয়ার উপায় নেই। আসতে হবে রাস্তার নীচ দিয়ে টানেল হয়ে । সেসব টানেল বেশ বড় ও নির্জন। একা কিঞ্চিত ভয় করে। আমাদের দেশে রাতের নির্জন স্থান বা টানেল ভয়ের ব্যাপার। সে ভয়টা বিদেশে এসেও দেখি , আছে।
আমি আনমনে আসছি- –
হটাৎ আমার কানে ধাক্কা দিলো একটা বাঁশির সুর।
যে সুর সন্ধ্যার পর আমার দেশের গ্রামের মাঠের প্রান্তে ভেসে বেড়ায়। সুমনের ‘বাঁশুরিয়ার’ মত । বাঁশুরিয়ার’ বাঁশির সেই কষ্টের সুর যেমন শহর ছাপিয়ে যায় এটাও অমন সুর ছিল। যেন বাঁশির সুরে তার অসীম কষ্টের কথা ফুটে উঠছে ।
আমি থমকে দাঁড়ালাম।
আবার হাঁটতে থাকলাম ।
দেখি সুরটা বাড়ছে ।দূর থেকে দেখি ,নির্জন এই টানেলে একজন ইস্ট ইউরোপিয়ান দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। পায়ের কাছে একটা পাত্র। সরাসরি বললে বলতে হয় ভিক্ষার পাত্র।
এরা শরনার্থী।
বৈধ কাগজপত্র নেই । তাই সন্ধ্যার পর এখানে সেখানে এরা এমন ভিক্ষাবৃত্তি করে। এমনিতে ভদ্র। আফ্রিকানদের মত আক্রমনাত্মক না। উন্নত জীবনের খোঁজে তারা ইউকে এসেছে।
ইস্ট ইউরোপের বিশেষ করে কম্যুনিস্ট ব্লকের দেশের মানুষদের এই অবস্থা। যেমন রোমানিয়া, বেলারুশ, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, স্লোভাক ইত্যাদি দেশের মানুষ এরা। সেভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এদের লোক দেখানো কমুনিজমের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ায় আজ এই অবস্থা। পুঁজিবাদদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ঐসব দেশের নেতারা দেশটাকে পঙ্গু করে ফেলেছিল বলে আজো দেশগুলি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
সেদিনের সেই আলো অন্ধকারে ইস্ট ইউরোপিয়ানদের এই দুরাবস্থা দেখে আমার মায়া লেগেছিল। আহা রে। আমাদের দেশের মানুষও তো ভাগ্য ফেরাতে ঐসব দেশে যায়, কত কষ্ট করে সার্ভাইব করে। আহা !
তাই, ওদের আমার খুব কাছের আর আপন মনে হল।
পকেট থেকে পাঁচ ইউরো দিলাম। চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি উপচে পড়ছিল। শুধু বাঁশিওয়ালা নয়, এক ভায়োলিন বাজানো রমনীকেও পেয়ে গেছিলাম এই নির্জন টানেলে, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা এক করুন সুরে ভরিয়ে তোলে পুরো নির্জন টানেল। সেই সুরে লেখা থাকে তার কষ্ট, না পাওয়ার বেদনা, তার ফেলে আসা নিজ শহরের বা গ্রামের অজস্র স্মৃতি,
নিশ্চই সে সেই সুরে বলতে চায়, মানুষে মানুষে এত বিভেদ, এত সীমানা এত পাসপোর্ট-ভিসা কেন ?
যে ক’দিন লন্ডনে ছিলাম সন্ধ্যায় টানেলে যেতাম ঐ মন খারাপ করা সুরের টানে।