বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানীকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলতে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এরই মধ্যে ড্যাপের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন ড্যাপে জনঘনত্ব বিবেচনায় অঞ্চল ভিত্তিতে ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি ভূমি ব্যবহারে বেশ কিছু নিয়ামক যুক্ত করা হয়েছে। ড্যাপের এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছে না আবাসন ব্যবসায়ীরা। তারা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে প্রস্তাবিত ড্যাপের বিরোধিতা করছে। এ অবস্থায় ড্যাপকে আটকে রেখে গণহারে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও বহুতল ভবনের অনুমোদন নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজউক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
রাজউকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজউকের ৮টি অঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রের জন্য মোটি ৬ হাজার ৭৬০টি নকশা জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৯৩টি আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের ১৬ জুন পর্যন্ত ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন পড়েছে ৯ হাজার ৯২১টি। এরমধ্যে ৫ হাজার ৯২১টির অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। সমহারে নাকশাও অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব জানিয়েছে, বর্তমানে বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের প্রায় তিন হাজার ফাইল রাজউকের চেয়ারম্যানের দফতরে পড়ে রয়েছে।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, ড্যাপের খসড়া প্রকাশের আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) যেখানে চার হাজার ৯৩টি ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেখানে করোনাকালীন চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) এর পরিমাণ হতে পারতো তার অর্ধেক। কিন্তু তা না হয়ে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অস্বাভাবিক এই ছাড়পত্র অনুমোদন দেওয়ার কারণ প্রস্তাবিত ড্যাপ। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন প্রস্তাবিত ড্যাপ অনুমোদন পেলে তারা বহুতল ভবনের অনুমোদন পাবেন না। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তারা।
ড্যাপ সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রস্তাবিত ড্যাপে উত্তরায় ৭-৮ তলা; গুলশান, বনানী ও বারিধারায় ৬-৮ তলা; খিলক্ষেত, কুড়িল ও নিকুঞ্জ এলাকায় ৬ তলা; মিরপুরে ৪-৭ তলা, মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়ায় ৫-৮ তলা এবং পুরান ঢাকায় ৪-৬ তলা আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব এলাকায় জমির দাম অনেক বেশি। তাই আবাসন ব্যবসায়ীরা মনে করছেন অতি দামে কেনা জমিতে সর্বোচ্চ ৮ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হলে ফ্ল্যাটের নির্মাণ খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে ফ্ল্যাটের দামে। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে আবাসন ব্যবসা।
জানা গেছে, গত ২ সেপ্টেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন ড্যাপের খসড়া প্রকাশ করে। খসড়া ড্যাপে পুরো ড্যাপ অঞ্চলকে ৪৬৮টি কমিউনিটি ব্লকে ভাগ করে প্রতিটি ব্লকের আবাসিক ভবনের জন্য সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য উচ্চতা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ঢাকার কোন এলাকা আবাসিক, কোনটা বাণিজ্যিক, কোনটা মিশ্র আবার কোনটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত হবে- এসব নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া জনঘনত্ব অনুযায়ী ভবনের এমন উচ্চতা নির্ধারণের পাশাপাশি জরিমানা দিয়ে অবৈধ ভবন বৈধ করা, ভূমির পুনঃউন্নয়ন, ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়ন, স্বত্ত্ব প্রতিস্থাপন পন্থা, জলাশয় রক্ষাসংক্রান্ত পরিকল্পনা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়নসহ নতুন কিছু বিষয় যোগ হয়েছে প্রস্তাবিত প্ল্যানে। সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত ড্যাপে ঢাকাকে ১৩ ধরনের ‘ভূমি ব্যবহার জোন’-এ ভাগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই ড্যাপ অনুমোদনের আগেই পুরানো পদ্ধতিতে বহুতল ভবন নির্মাণ ও ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন নিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে ভূমি মালিক ও ডেভেলপার কোম্পানিগুলো।
বিষয়টি স্বীকারও করে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেছেন, ড্যাপে ভবনের উচ্চতার বিষয়ে যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। কারণ ঢাকা শহরে জমির দাম অনেক বেশি। অতি দামে কেনা জমিতে সর্বোচ্চ ৮ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হলে অ্যাপার্টমেন্টের দাম ডাবল হয়ে যাবে।
ড্যাপের বিরোধিতা করে তার অনুমোদন আটকে রেখে সুযোগ নেওয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে তার কিছুটা প্রবণতা তো আছেই। ব্যবসায়ীরা নিরাপত্তা চায়। নতুন ড্যাপে ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ কিছু আশঙ্কা রয়েছে। সেকারণেই তারা ছাড়পত্র ও নকশার অনুমোদন নিয়ে রাখাতে চাইছেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রায় তিন হাজার বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য রাজউক চেয়ারম্যানের দফতরে রয়েছে। আগের চেয়ারম্যান কোনও ফাইলে সই করেননি। আমরা বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন যত দ্রুত সম্ভব ফাইলগুলোর অনুমোদন দেবেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)’র সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপ অনুমোদনের বর্ধিত সময়ও পার হয়ে গেছে। এরকম দীর্ঘসূত্রতা যখন চলতে থাকে, তখন এর সুযোগ নেয় দুর্বিৃত্তরা। কারণ এই ড্যাপ পাশ হয়ে গেলে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ বা ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন পাবে না। এ জন্যই সরকারের দায়িত্ব ছিলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ড্যাপ অনুমোদন করে দেওয়া।
ড্যাপ রিভিউ কমিটির আহ্বায়ক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, রিভিউ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমার কাছে যে বিষয়গুলো এসেছে সেগুলোর বিষয়ে মতামত দিয়ে ঠিক করে নিতে বলেছি। আশা করি খুব দ্রুত তা ঠিক করে নেওয়া হবে।
ড্যাপের পরিচালক ও রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনের জন্য রাজউকে আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আবেদন পড়ছে। ড্যাপ যেহেতু এখনও অনুমোদন পায়নি সেকারণে আগের নিয়মেই আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি খুব দ্রুত ড্যাপের গ্যাজেট প্রকাশ করতে। গ্যাজেট হয়ে গেলে এই সমস্যাগুলো থাকবে না।
প্রস্তাবিত ড্যাপে, পুরো মেট্রোপলিটন এলাকার প্রায় ৯৪ হাজার ৫৮ দশমিক ৪২ হেক্টর জমি নগর এলাকা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসিক এলাকা হিসেবে ১৯ হাজার ৪৫৭ দশমিক ৬৭ একর ব্যবহার করা হবে, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক প্রধান) হিসেবে ব্যবহার হবে এক লাখ ২৩ হাজার ৯৩১ দশমিক ০৯ একর। মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক-বাণিজ্যিক) হিসেবে এক হাজার ৭৭৮ দশমিক ৯৩ একর ব্যবহার করা যাবে।
এছাড়া ভূমি ব্যবহারে আরও ৮টি নিয়ামককে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এগুলো হচ্ছে, বন্যা ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, মুখ্য জনস্রোত এলাকা, সাধারণ জনস্রোত এলাকা, সাধারণ বন্যা অববাহিকা, দুর্যোগ সংক্রান্ত, ভূ-তাত্ত্বিক ও ভূ-কম্পন সংক্রান্ত, বিশেষ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেডিআই)।