ফাঁকা সড়ক, বাজার-গলিতে জঁটলা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

কঠোর বিধিনিষেধ দেখতে বেরিয়ে আটক ২৭১


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : মহামারি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সর্বাত্মক কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা কম থাকলেও অলি-গলিতে জটলা দেখা গেছে। বৃষ্টি আর অফিস বন্ধ থাকায় মূল সড়কগুলোতে মানুষের সমাগম না থাকলেও অলিগলি এবং কাঁচা বাজারগুলোর অবস্থা আগের মতোই। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন। এতে কেউ কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানলেও অনেককেই তা মানতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ দেখতে বেরিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৭১ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
সরেজমিনে রাজধানীর পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, কাকরাইল, ফকিরাপুলসহ আশপাশ এলাকা ঘুরে এমনটাই লক্ষ্য করা গেছে।
করোনা সংক্রমণ কমাতে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। মহানগরীতে এটা নিশ্চিত করতে মাঠে অবস্থান করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়ায় শহরের মূল সড়কগুলো ফাঁকা দেখা গেছে। তবে ভিন্ন চিত্র ছিলো অলিগলির। সে দিকটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি না থাকায় চিত্র ছিলো আগের মতোই।
নয়া পল্টন মসজিদ গলিতে গিয়ে দেখা যায় জায়গায় জায়গায় মানুষ। যাদের অনেকেই অকারণে বাসা থেকে বেরিয়েছেন। তিন/চার জন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন কাফিল উদ্দিন নামে একজন। তিনি বলেন, ‘ঘরের মধ্যে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। এক কারণে একটু বেড়িয়েছি। সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় জরুরি আলাপ করছি।’
সেখান থেকে একটু সামনে গেলে আরেক জটলা দেখা যায়। কমপক্ষে ৬/৭ জন। মাস্ক ছিলো না কারো মুখেই। তাদের মধ্যে একজন শাহ আলম বলেন, ‘আমরা সবাই সংবাদ কোম্পানিতে চাকরি করি। থাকিও এক সাথেই। এমনিই বের হইছে।’
এরকম জটলা ছাড়াও গলিগুলোতে চলাচল করছে সাধারণ মানুষ। আকরাম হোসেন নামে একজন বলেন, ‘ভাই, বের তো হতেই হবে। বাজার না করলে খাবো কি?’
পুরানা পল্টন এলাকার কামাল মিয়া নামে একজন বলেন, ‘পুলিশের গাড়ি আইলে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। পুলিশ চলে গেলেই মানুষ রাস্তায় বের হইয়া আসে।’
এদিকে মানুষের ঢল দেখা গেছে ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে। বৃষ্টির মধ্যেও প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে মানুষ বের হয়েছেন। মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। কেউ কেউ নামে মাত্র থুতনির নিচে ঝুলিয়ে রেখেছেন মাস্ক।
এখানকার সালমা বেগম নামে একজন বলেন, ‘এখানে পুলিশ আহে নাই। এজন্যই মানুষ মাস্ক ছাড়া বের হইছে। ভিড় করতেছে।’
এছাড়াও আশপাশের কাঁচাবাজারগুলো অনেকটা আগের মতোই দেখা গেছে। ফকিরাপুল বাজারে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বাজার করছিলেন ওছমান মিয়া। জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেভাবে কাজ বন্ধ হইয়া যাইতা আছে। না খাইয়াই মইরা যাইতে হইবো। মাস্ক পইরা লাভ নাই।
চার-পাঁচজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সবজি কিনছিলেন। সেখানে রতন মিয়া নামে একজন বলেন, ‘বাজারের অবস্থা যদি এমনই হয় তাহলে বিধিনিষেধ দিয়ে লাভ কি? বাজার থেকেই বাড়িতে করোনা নিয়ে যাবে। কোন না কোনভাবে প্রত্যেকটা পরিবারকেই আসতে হয় বাজারে। তাই এখানকার (বাজার) স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা প্রথম জরুরি।’ এছাড়াও মানিকনগরের কাঁচাবাজার অনেকটা আগের মতোই দেখা গেছে। অলি-গলিতে মানুষের জঁটলা দেখা গেছে।
সবারই আছে ‘অজুহাত’ : পুলিশ প্রাইভেটকারটি থামাতেই দেখা গেল ভেতরে গাদাগাদি করে ছয়জন বসে আছেন। লকডাউনে কেন বের হয়েছেন- পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইলে, ভেতরে বসা বয়স্ক ব্যক্তিটি একটি চিকিৎসাপত্রের ফাইল এগিয়ে দিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা দেখলেন, রোগীকে গত ২৫ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।
‘রিলিজ তো ২৫ জুন হয়েছে। আজ কোথায় গিয়েছেন’- পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি সামনের সিটে বসা এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিতে দেখিয়ে বলেন, ওর চিকিৎসা হচ্ছে। সমস্যা হওয়ায় আজ আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে।
আজ চিকিৎসার কাগজ কোথায়-পুলিশ জানতে চাইলে ওই মুরব্বি বলেন, আজ কোনো কাগজ দেয়নি।
অনুনয়-বিনয়ের একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা গাড়িটি ছেড়ে দেন। এই ঘটনা কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিন সকালে পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড চেকপোস্টে। এই মহাসড়ক ধরে পণ্যবাহী যানবাহন ছাড়াও প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে।
পুলিশ প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল দেখলেই থামাচ্ছেন- কিন্তু সবাই কোনো না কোনো অজুহাত দেখাচ্ছেন। বাইরে বের হওয়ার কারণ একেবারে অযৌক্তিক হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানবিক বিবেচনায় দেয়া হচ্ছে ছাড়।
মো. রুবেল হোসেন মোটরসাইকেলে স্ত্রী ও বাচ্চা নিয়ে রওনা হয়েছেন। চেকপোস্টে আটকে দেয় পুলিশ। রুবেল বলেন, আমরা শাশুড়ি খুব অসুস্থ, তাই স্ত্রীকে নিয়ে চাঁদপুর যাচ্ছি। পুলিশ জানতে চান-আপনার শাশুড়ি যে অসুস্থ এর প্রমাণ কী? আপনার মোটরসাইকেলে তো হাঁড়ি-পাতিল।
এবার রুবেল বলেন, ‘আমি শ্যামলি গাড়ির ড্রাইভার। বাসাও ছেড়ে দিছি স্যার, তাই সামান্য কিছু মালসামানা ছিল সেগুলোও নিয়ে নিছি।’
এবার রুবেলের স্ত্রী বলেন, ‘স্যার আমরা মিথ্যা কইতাছি না। আমরা মায়ের অসুখ। লকডাউন জানি তারপরও বাইর হইছি। কী করমু স্যার।’
একপর্যায়ে পুলিশ ছেড়ে দেয় মোটরসাইকেলটি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই কর্মী এক মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন, আরোহীর মাথায় হেলমেটও ছিল না। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ায় হেলমেট নিতে পারেননি। তারাও জরুরি কাজ করছেন বলে দাবি করেন। পুলিশকে তাদের ছেড়ে দিতে হয়।
ব্যাটারিচালিত রিকশাকেও সুযোগবুঝে মহাসড়কে আসার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। এমন একটি রিকশা আসতে দেখে পুলিশ দূর থেকে ইশারা করতেই চালক ঘুরিয়ে উল্টো ছুট।
একটি পিকআপভ্যানে আট থেকে ১০ জনের মতো লোক দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশ থামাতেই তারা বললেন, যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে সবজি নিয়ে এসেছেন তারা সবজিবিক্রেতা। কিন্তু পিকআপে নামমাত্র সবজি ছিল।
রায়েরবাগ চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন ডেমরা ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের মূল চেকপোস্ট এই মহাসড়কের কুবা মসজিদ এলাকায়। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যারা চলাচল করতে পারবেন, আমরা শুধু তাদেরই অ্যালাও করছি। বাকিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘বিদেশফেরত যাত্রীদের গাড়ি আসছে, আমরা তাদের ছেড়ে দিচ্ছি। শিল্প-কারখানার কর্মী বহনকারী গাড়িগুলোকেও আমাদের চলতে দিচ্ছে হচ্ছে। নিয়ম না মেনে চলাচল করায় দুটি মাইক্রোবাসের বিরুদ্ধে আমরা মামলা দিয়েছি।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়েছে সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ। এই বিধিনিষেধ থাকবে আগামী ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত।
এ সময়ে জরুরি সেবা দেয়া দফতর-সংস্থা ছাড়া সরকারি-বেসররকারি অফিস, যন্ত্রচালিত যানবাহন, শপিংমল দোকানপাট বন্ধ থাকবে। খোলা থাকবে শিল্প-কারখানা। জনসমাবেশ হয় এমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে না।
কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বুধবার (৩০ জুন) মন্ত্রিপরিষদি বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেখানে ২১টি শর্ত দেয়া হয়েছে।
কঠোর বিধিনিষেধ দেখতে বেরিয়ে আটক ২৭১ : দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ দেখতে বেরিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৭১ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তাদের আটক করা হয়। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৭৩ জন।
জানা যায়, রাজধানীর তেজগাঁও, শাহবাগ, রমনা, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, মিরপুর, গুলশান থেকে তাদের আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃতদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা করা হয়।
লকডাউনের প্রথম দিন রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে কাঁচা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারে ঢিলেঢালা অবস্থা দেখা গেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাহাতাব উদ্দিন বলেন, লকডাউন না মানায় এখন পর্যন্ত মিরপুর অঞ্চলেই শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। মামলা হয়েছে অর্ধশত। এ ছাড়া লকডাউন ভঙ্গ করায় ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৬৭ জনকে আটক করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সরকার এ বছর প্রথমে ৫ এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ দিয়ে আসছে। দেশব্যাপী বিধিনিষেধের পাশাপাশি এবার স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ বিধিনিষেধ জারি করছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। যা চলবে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত।