১৫ই আগস্টের হত্যাকান্ড ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

সম্পাদকীয়

ডা. এস এ মালেক : যে মৃত্যুর কথা কেউ কোনোদিন চিন্তাও করেনি, স্বপ্নেও ভাবেনি, সেই অপ্রতাশিত নির্মম ঘটনা ঘটে গেল ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে। বিজয়ের পর যখন দেশে ফিরে তিনি রাষ্ট্রের পরিচলিনভার গ্রহণ করলেন, তখন এদেশের মানুষ ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু যতদিন জীবিত থাকবেন, ততদিন এদেশ শাসন করবেন। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তিনি তার দায়িত্ব পালন করে যাবেন। কিন্তু ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাকে নিহত হতে হল তারই দেশের মানুষের হাতে। এদেশের মানুষ তাকে হত্যা করেছে কথাটা বোধহয় সঠিক নয়। হ্যা একথা ঠিক, মোশতাক তার দলের লোক। আর ফারুক ডালিম, রশিদ, এদেশরই সন্তান। তাই সাধারন বিবেচনায় বলতে হয় যে লোকটি তার গোটা জীবনকে স্বপে দিলেন দেশের কারনে। ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ১৪ বছরের কারাবরণকে উপেক্ষা করে বাংলার গণমানুষের জন্য কাজ করলনে, সেই বাঙালী কি করে তাকে হত্যা করতে পারে। আসলে যারা হত্যাকারী তারা মন ও মানষিকতায় ছিল পাকিস্তানী, বাঙালী জাতীয়তাবাদে তারা বিশ্বাসী ছিল না। বিশ্বাসী ছিল পাকিস্থানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে। তাই পাকিস্থান ভাঙ্গার প্রতিশোধ হিসেবে তারা বাংলাদেেশর প্রতিষ্ঠাতাকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করার মতো সাহস তাদের কখনও ছিল না। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। বিন্দুমাত্র বাঙ্গালীত্ব বোধ থাকলে এদেশের জনগণের প্রতি দরদ থাকলে তারা এদেশরে শ্রেষ্ঠ সন্তানকে এভাবে হত্যা করতে পারে না। তারা কি কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তার বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস জাতীয় দলিল হিসেবে হয়তো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু হত্যার মূল কারণ এখনও উদঘাঠিত হয় নি। খুনীরা বলছে ডালিমের ব্যক্তগিত আক্রোশের কারণে সে ভারাটেদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আরেকদল বলছে গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ কামাল ও ডালিমের অন্তদ্বন্দের কারণে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছে। এসব একেবারেই অমুলক উক্তি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ছিল রাজনৈতিক। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানের কারাগারে যখন তিনি আবদ্ধ, তাকে যখন পাকিস্তান ভাঙ্গার অপরাধে বিচার করা হয়েছিল তখন তারা অতি সহজেই তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে পারতো। তা কিন্তু করা হয়নি। সেদিন সাম্রাজ্যবাদ ভেবেছিল যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশীর্ষ শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পুজিবাদী বুর্জোয়া গনতন্ত্রের ধারক এবং বাহক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশীর্ষ আর কতদুরই বা অগ্রসর হবে। তাই ৭২ এ সংবিধান প্রনয়ন, ৭৩ এ নির্বাচন ও বাংলাদেশে সংসদীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা সহযোগিতা না করলেও চরম বাধা সৃষ্টি করেনি। কিন্তু এদেশের দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যখন তার ২য় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষনা দিলেন ঠিক তার পূর্বেই তাকে হত্যা করা হল। যদিও বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি মার্সিও দর্শন ভিত্তিক আর্থ-রাজনৈতিক ধারা ছিল না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বিদেশ থেকে তন্ত্র-মন্ত্র ধার করে নয়, আমার দেশের মাটি ও মানুষের প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সমাজবাদ তিনি প্রতিষ্ঠা করবেন। আর ঐ গণতান্ত্রিক সমাজবাদের কর্মসূচী ২য় বিপ্লবের মাধ্যমে ঘোষনা করেছিলেন।
রেজিমেন্টেড সোসাইটির মতো তিনি ব্যক্তিগত ভোটের অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার কখনোই তুলে নেন নি। তাই আপসোস বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করলো বিশেষ করে পিছনে থাকা সাম্রাজ্যবাদ তারা বঙ্গবন্ধুকে তার কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় ও সুযোগ দেয় নি। তিনি তার ২য় বিপ্লবে যে গভর্ণর সিস্টেম জেলা প্রশাসনের চালু করেছিলেন তাতে তিনি সর্বস্তরের লোককে সংশ্লিষ্ট করেছিলেন। প্রশাসক হিসেবে গভর্ণরের ব্যাক্তিগত ইচ্ছা পূরণ করার কোন সুযোগ ছিল না। সকলের মত ও সমর্থন নিয়ে প্রশাসনকে দায়িত্ব পালন করতে হতো। ব্রিটিশ কলোনিয়াম যে প্রশাসন তা তিনি ভেঙ্গে গণপ্রশাসন চালু করতে চেয়েছিলেন। তার মূল ছিল পার্টিসিপেটারি গণতন্ত্র। সর্বস্তরের লোকদের প্রশাসনে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেওয়া। যাকে এক কথায় গণপ্রশাসন বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এটা সেচ্ছাচারী একদলীয় ভিিিত্তক কোন ব্যবস্থা ছিল না। একইভাবে তিনি যে বাধ্যতামূলক গ্রাম্য সমবায়ের রুপরেখা দিয়েছিলেন, সেটা ছিল এমন এক সমবায় যাতে করে শুধু খাদ্য নয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রয়োজন মিটাবার ব্যবস্থা। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, উৎপাদিত ফসল যাতে সকলে সমবায়ের মাধ্যমে সমানভাবে পেতে পারে তার ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। শুধু কৃষি উন্নয়ন নয়, মানবউন্নয়নের সবকিছু ছিল এই কো-অপারেটিভ এ। বিচার ব্যবস্থায় তিনি আমূল পরিবর্তন এনে গরীব-দ্ঃুখী মানুষের কাছে বিচার ব্যবস্থা পৌছে দিয়েছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি বিজ্ঞান ভিত্তিক কুদরত-ই কুদা কমিশন বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করেছিলেন। আসলে এর কোনকিছু বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল। আর এখন প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ২য় বিপ্লবের কারনেই নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে। তখন ২য় বিপ্লব ছিল আতুর ঘরে, কোনোকিছুই বাস্তবায়িত হয় নি। তাহলে প্রশ্ন জাগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল কেন? চক্রান্ত ছিল সাম্রাজ্যবাদ ঠিকই, কিন্তু যারা অতি উৎসাহে এই হত্যাকান্ড সংঘঠিত করেছেন তারা ছিলেন বাংলাদেশের ঘোর শত্রু। তারাই সাম্রাজ্যের উপর চাপ সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড অনুমোদন করিয়ে নেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ৪৫ বছর পর আজকের সুক্ষ বিচারে এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা যে অমূলক নয় তা সকলে অনুধাবন করছে।
(লেখক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লষক)


বিজ্ঞাপন