জাতীয় শোক দিবস
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রক্ত ও অশ্রুঝরা শোকাবহ ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির শোকের দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬ তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিন সঙ্ঘটিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। দেশি-বিদেশী চক্রান্তে কুচক্রী মহল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি যথাযথ মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্যে শ্রদ্ধার সাথে দিবসটি পালন করবে। তবে এবার বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করেই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বংশপরিচয়-
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। লুৎফর- সায়েরা দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। বংশ পরিচয়- সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ জাতির ইতিহাসে অবিসংবাদিত মহানায়কের রয়েছে সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তার মাঝে আশৈশব ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনাবোধের উন্মেষ ঘটে। সমৃদ্ধ বংশ পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে। ইসলাম ধর্মেও বংশ পরিচয়ের মূল্যায়নে শিক্ষণীয় নির্দেশনা দেয়া আছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। মূলত ইসলাম বংশ পরিচয়ের আভিজাত্যকে গৌণ রেখে যোগ্যতা, বিশ্বাস ও ন্যায়নীতি-নিষ্ঠাকে ব্যক্তির মর্যাদার মানদ- নির্ধারণ করে। এ সার্বজনীন ও মানবিক বিধান মেনে বলা যায়-ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় ও বংশীয় ঐতিহ্য অনেক সময় ব্যক্তির রুচিবোধ, স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক বা সম্পূরক ভূমিকা পালন করে। ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ব্যক্তি ঐতিহ্যগতভাবেই সাধারণত উন্নত মানসিকতা ও সমৃদ্ধ রুচিবোধের পরিচয় বহন করেন।
মুজিবুর রহমান সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারক। তিনি ‘শেখ’ বংশীয় উত্তরাধিকার বহন করেন। ‘শেখ’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে, যার অর্থ শক্তিশালী, বলবান, বিপুল ক্ষমতাধরসম্পন্ন। এটি সম্মানসূচক আরবি অভিধা বা পদবী হিসেবেও পরিচিত। বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাবান শাসকদের উপাধি হিসেবেও শেখ-এর ব্যবহার রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও মানুষের নামের পূর্বে এটি ব্যবহৃত হয়। ল্যাটিন শব্দ ‘সেনেক্স’-এর বাংলা ‘বয়োবৃদ্ধ বা সম্মানিত’। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘শেখ’। তবে বর্তমানে এ পদবীতে পরিচিত ও সংশ্লিষ্টদের নেপথ্যে রয়েছে অনবদ্য তাৎপর্য। ইসলামের মহানবী, মানবতার পরম বন্ধু, মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অনেককে সরাসরি মুসলিম করেন। ইতিহাসে তারা ‘শেখ’ অভিধায় ভূষিত।
আমাদের এ প্রাচীন বঙ্গীয় জনপদে অসংখ্য ব্যক্তি ইসলামের শাশ্বত বাণী নিয়ে আসেন। তাদের অধিকাংশই আরব ও পারস্য থেকে কালের নানা সন্ধিক্ষণে এ ভূখ-ে আগমন করেন। তন্মধ্যে অনেকে ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবী। পরবর্তী কালে আরো আসেন সুফি, দরবেশ, গাউস, কুতুব, অলি ও বুজুর্গ।একদা মহামতি শেখ আউয়াল নামে এমন দরবেশের আগমন ঘটে এ বঙ্গে। আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু তারই বংশের সৌভাগ্যবান অধস্তন বংশধর। তাকে খোকা বলে ডাকতেন বাবা লুৎফর ও মা সায়েরা। তাদের ধারণকৃত ভিডিও দলিলের বরাত দিয়ে বলা যায়, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আজীবন অকুতোভয়, সৎ সাহসী, আপোষহীন সচ্চরিত্র, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দৃঢ়চেতা, স্বাধীনতাপ্রিয়, নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন, দরিদ্রের প্রতি দয়ালু, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ সম্পন্ন এবং বাবা-মায়ের কথা পালনে অন্যরকম বাধ্য ছিলেন বলে উল্লিখিত দলিলে পাওয়া যায়।
শেখ আউয়াল ব্যাবিলনীয় সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে বিশ্বখ্যাত অলি হযরত বায়েজিদ বোস্তামির (রা.) সফর সঙ্গী হয়ে বঙ্গে আগমন করেন। ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত ছিল তাদের। এ মহান অলি সমুদ্রপথে জাহাজে করে আসেন। প্রথমে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে আস্তানা গাড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ আউয়াল দরবেশেরই সপ্তম অধস্তন বংশধর ছিলেন। তার বংশীয় ঊর্ধ্বতনদের খ্যাতনামা আরেক ব্যক্তি হলেন শেখ বোরহান উদ্দিন। তিনি আউয়ালের ছেলে শেখ জহির উদ্দিনের দৌহিত্র ছিলেন। বোরহান উদ্দিনের বাবা ছিলেন শেখ জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি।বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প গ্রন্থের বরাত দিয়ে বলা যায়, অলিকুল শিরোমণি বায়েজিদ বোস্তামির (রা.) নির্দেশে মেঘনা পাড়ে গমন করেন শেখ আউয়াল। এতদঞ্চলের অধিবাসীদের মাঝে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেন তিনি। পরে এ দরবেশ চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও এলাকায়। সেই সুবাদে শেখ আউয়ালের সন্তান শেখ জহির উদ্দিনও এ অঞ্চলেই বসবাস করেন। পরে জহির উদ্দিনের ছেলে তেকড়ি শেখ খুলনার দিকে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা। একসময় তেকড়ির ছেলে শেখ বোরহান উদ্দিন জনৈক বন্ধুর কাছে মধুমতি ও ঘাঘোর নদীদ্বয়ের মাঝখানে গড়ে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামের কথা জানতে পারেন। পরে বন্ধুকে নিয়ে রূপসা নদী অতিক্রম করে সেখানে চলে আসেন। একপর্যায়ে কাজি পরিবারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বাকিজীবন এখানেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। আর এভাবেই বিখ্যাত শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন হয় ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে। বোরহান উদ্দিনের ছেলে শেখ আকরাম হলেন বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের দাদা। আর শেখ লুৎফর রহমান হলেন শেখ আব্দুল হামিদের সন্তান। কালক্রমে উত্থান-পতন ঘটেছে শেখ পরিবারের। নাম-যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ, বিত্ত-বৈভব হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তার সুমহান ঐতিহ্য ও পরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাস কখনই বিস্মৃত হয়নি। বরং সময়ের বিবর্তনে সেই পরিবার সুকীর্তির শীর্ষে উপনীত হয়েছে। এমন আলোর বিচ্ছিরণ ঘটিয়েছে যা আর কখনই ম্রিয়মান হওয়ার নয়। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দেশে ইসলামের প্রকৃত পরিচর্যাকারী। পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং হজ ভ্রমণ কর বাতিল করেন। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা ইতিহাসে চিরদিন লেখা থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে ৩ বছর এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, পৃথিবীতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামের উন্নয়ন করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কর্মকা-কে যথাযোগ্য মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। স্বাধীন দেশের ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্মূলের সাফল্যও তার সরকারের বড় অবদান। বাংলাদেশকে সব ধর্মের সব মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতেবঙ্গবন্ধু ছিলেন সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের অনুগমী। তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানামুখী ব্যবস্থা। তিনি যেমন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, তেমনি বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্থপতিও তিনি।আর বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কর্মপ্রয়াস ছিল বাংলার জনগণের শোষণ ও মুক্তির অন্বেষণ। বঙ্গবন্ধু ধার্মিক; কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বা সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় মানস গড়ে ওঠার পেছনে অন্তত চারটি প্রভাব কার্যকর ছিল বলে মনে হয়। পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশ। প্রতিদিন ভোরে বাড়িতে ফজরের নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত ও নিয়মিত নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে তার জীবন বিকশিত ও বিবর্তিত হয়েছিল।তিনি ইসলামের উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক সাম্য ও মৈত্রীর চিরন্তন ভিত্তিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামি অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের প্রচার প্রসারে যে অবদান রেখেছেন, তা সমকালীন ইতিহাসে বিরল। আজ বঙ্গবন্ধুর ইসলাম নিয়ে বিশেষ কলাম লিখেছেন, বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডা. এম এম মাজেদ তাঁর কলামে লিখেন…. বঙ্গবন্ধু উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান ছিলেন। তিনি কখনও ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করেননি। বাংলাদেশকে সব ধর্মের মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ইসলামের প্রচার-প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান অনেক। এ সরকার মসজিদ মন্দিরের যে উন্নয়ন করেছে তা কল্পনাতীত। ১০ হাজার কেটি টাকা ব্যয়ে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গত ১০ জুন ২০২১, ১১:৪১: মিনিটে সারাদেশে নির্মিত একযোগে ৫০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০ জুন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে একযোগে আধুনিক ও সুসজ্জিত এই মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনকালে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসিলম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের কথা মনে রেখে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ২. জাতীয় পর্যায়ে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা.) পালন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম হাক্কানী আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে পবিত্র ইসলামের সঠিক রৃপ জনগণের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সীরাত মজলিশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সীরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাযতুল মুকাররম সমজিদ চত্বরে মাহফিলের উদ্বোধন করেন।একজন সরকার প্রধান হিসেবে জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিলের উদ্বোধন উপমাহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকাতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল উদযাপন হয়ে আসছে। ৩. হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন। ৪. মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন ইসলামি আকিদা ভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন। পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্ত্বশাসিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করে এর নাম রাখেন “বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড”। ৫. বেতার ও টিভিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রচার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত ও তাফসীর প্রচার শুরু হয়। ফলে, বেতার ও টিভির অনুষ্ঠান সকালের সূচনা ও দিবসের কর্মসূচি কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত এ ব্যবস্থাই বাংলাদেশে চালু রয়েছে। ৬. ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা.), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা। ইসলামের ধর্মীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা.), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। উল্লিখিত দিনসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। ৭) মদ, জুয়া, হাউজ ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান করা। ইসলামে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অবাধে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান জারি করেন। ৮) ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতা নিষিদ্ধকরণ পাকিস্তানি আমলে ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। সেখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতার নামে চলত জুয়া, হাউজি ও বাজিধরা প্রতিযোগীতা। এই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে বাজিতে হেরে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যেতো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতা বন্ধ করেন এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বৃক্ষরোপণের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যদি মনে কর আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি বৃক্ষের চারা রোপন কর।” মহানবী (সা.) এর এই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে রেসকোর্স ময়দানের অনৈসলামিক কর্মকা-ের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি সেখানে বৃক্ষরোপণ করে সেই স্থানের নাম রাখেন “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।” ঢাকা মহানগরীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষরাজি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবহণ করে চলেছে। ৯. বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জায়দা বরাদ্দ তাবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামের পথে দাওয়াত দেওয়াই হচ্ছে এ সংগঠনের একমাত্র কাজ। এই সংগঠনটি যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দাওয়াতি কাজে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার তাবলীগী ভাই এ জামাতে সমবেত হন। বঙ্গবন্ধু টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার এই স্থানটি বরাদ্দ করেছিলেন বলেই ইজতেমায় আগত লক্ষ লক্ষ মুসলিম এখানে সমবেত হয়ে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ১০) কাকরাইলের মারকাজ মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ। বর্তমানে কাকরাইলের যে মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলীগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এ মসজিদটি ছিল খুবই অপ্রশস্ত। বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের তাবলীগ জামাতের মারকাজ মসজিদের জন্য স্থান বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তারই নির্দেশে সম্প্রসারিত হয়। ১১. রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিস্ট দেশ। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে তাবলীগ জামাতের যেসব দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১২) আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আবর বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখর চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে এক লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করা হয়। ১৩) ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা সমুন্নত হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে।এভাবে পর্যলোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে বিপুল অবদান রাখেন, গোটা পৃতিবীতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। তবু ইসলামের লেবাসধারী একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে, যা এখনও চলছে-নানা কৌশলে, নানা আঙ্গিকে। পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর ইসলাম ছিল ইসলামের মর্মশাঁসলগ্ন, ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক ইসলাম নয়। অন্যদিকে তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ধর্মীয় গণতন্ত্র বা ধর্মীয় বহুত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন। বাংলার ধর্মীয় ঐতিহ্য বহুত্বের ও সহিষ্ণুতার। ফলে তার আমলে ইসলামী মূল্যবোধ যেমন সংরক্ষিত ও বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি অন্যান্য ধর্মও অবস্থান করেছে স্বমহিমায়। ধর্ম-বৈচিত্র্যের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্য কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন।
লেখক : কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি