“বঙ্গবন্ধুর দাফন প্রত্যক্ষদরশীর বিবরণ” বইয়ের আলোকে
আজকের দেশ রিপোর্ট : ১৬ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে একটি টেলিফোন কল আসে গোপালগঞ্জ মহকুমার পুলিশ অফিসার নুরুল আলমের টেলিফোনে। কলটি করেছিলেন বঙ্গভবন থেকে এক আর্মি অফিসার।
নুরুল আলম ‘বঙ্গবন্ধুর দাফন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ বইয়ে বলেছিলেন, ‘১৬ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে টেলিফোন আসে। এবার অপর প্রান্ত হতে বললেন ‘আমি ঢাকার এসপি আব্দুস সালাম বলছি। আপনি এসডিপিও বলছেন? জ্বি বলতেই তিনি জানালেন দুপুরের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। বাবা-মার কবরের পাশে তাঁর লাশ দাফন করে রাখবেন। যাতে কবরের মধ্যে কফিনসহ লাশ রেখে তাড়াতাড়ি মাটি দেয়া যায়। ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ কবর দিয়ে হেলিকপ্টার ফিরে আসবে। হেলিকপ্টার নামানো, লাশ কবর দেয়া এবং ওই লাশ যাতে কবর হতে কেহ উঠায়ে নিতে না পারে তার জন্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। গোপালগঞ্জ পুলিশলাইন এবং নিকটস্থ থানা/ফাঁড়ি হতে পুলিশ এনে টুঙ্গিপাড়ায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যাতে আর্মিরা লাশ তাড়াতাড়ি দাফন করে নিরাপদে ঢাকায় চলে আসতে পারে।’
কিন্তু সেই নূরুল আলমের মধ্যে একটি চিন্তাও একই সঙ্গে দানা বাঁধতে থাকে। যার মরদেহ দাফন করা হবে তা আসলোই বঙ্গবন্ধুর কি না। এ জন্য তিনি মুখ দেখার জন্য জানাজার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করেন।
‘১৬ আগস্ট। মেঘভাঙা রোদের অগ্নিঝরা দুপুর। টুঙ্গিপাড়া যেন হিমশীতল পরিবেশে পিনপতন নিস্তব্ধতায় অপেক্ষা করছে তারই কোলেপিঠে বড় হওয়া বাংলা মায়ের দামাল ছেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গভীর স্নেহে তার বুকে আশ্রয় দিতে। কয়েকজন ব্যাংক কর্মচারী, চারজন কফিন বহনকারী, কবরের পাশে চার থেকে পাঁচজন কবর খননকারী ও পুলিশ ছাড়া সেদিন পুরো টুঙ্গিপাড়া এলাকা জনমানবশূন্য ছিল। কোথাও লোকজনের চলাচলের সাড়াশব্দ নেই। দোকানপাট, হাসপাতালসহ সবকিছুর দরজা-জানালা বন্ধ।
দুপুর দেড়টার দিকে হবে, হঠাৎ হেলিকপ্টারের আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টুঙ্গিপাড়ার আকাশে হেলিকপ্টার দেখা গেল। … হেলিকপ্টারে করে রাষ্ট্রপতির মরদেহ পাহারা দিয়ে এসেছিলেন মেজর কাজী হায়দার আলীর কমান্ডে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন (যিনি ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানে নিহত) একজন হাবিলদার ও ১০ জন সৈনিক। এ ছাড়া হেলিকপ্টারে ছিলেন দুজন পাইলট। তারা হেলিকপ্টার থেকে নিচে নামেননি। ফ্লাইট লে. শমসের আলী হেলিকপ্টার চালিয়ে এসেছিলেন।’
জানাজা করার জন্য মেজরের কাছে অনুমতি চাওয়ার পর তিনি প্রথমে ক্ষেপে গেলেও পরে রাজি হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলার মতো কোনো জিনিসই পাওয়া যাচ্ছিল না তখন। সবাই পালিয়েছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দীর্ঘদিনের কাজের লোক বৈকুণ্ঠও পালিয়েছিলেন। পাশের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে কাঁচি ও হাত কোদাল সংগ্রহ করে কফিন বক্সের ডালা খুলে মাটিতে রাখেন। মেজর হায়দার বঙ্গবন্ধুর লাশ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তার আত্মীয়দের খুঁজেন।
লাশ পেঁচানো সাদা কাপড় খুলতেই দেখা যায়, থান কাপড়ের একটি লম্বা টুকরার ওপর লাশ রেখে পায়ের দিক হতে কাপড়টি মাথার দিকে এনে মুড়িয়ে গিট দিয়ে রেখেছে। গিট খুলে মুখ বের করতেই দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু যেন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন।’
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে টুঙ্গিপাড়া সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাসেম, আব্দুল হাই মেম্বর, আকবর কাজী, মো. ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টারসহ অন্যরা বাড়িতে লাশ বহন করে আনেন। কফিন খুলে লাশ বের করে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়। রেডক্রিসেন্টের রিলিফের শাড়ি দিয়ে কাফন পরানো হয়। সেনা ও পুলিশ হেফাজতে তড়িঘড়ি করে দাফন সম্পন্ন করার ফলে মাত্র ৩০/৩৫ জন অংশ নেন, জানাজায় গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগে থেকেই টুঙ্গিপাড়ায় কবর খুঁড়ে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনে গ্রামের মানুষ অংশ নিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পথেই পুলিশ,সেনা সদস্যরা তাদের বাধা দিয়ে আটকে দেন। তারা দাফনে অংশ নিতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারী টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. ইলিয়াস হোসেন বলেছিলেন,
‘কফিন বহন করার জন্য আমিসহ অন্যান্যদের ডাকা হয়। আমরা হেলিকপ্টারের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর কফিন বের করে তার বাড়িতে নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা সেনা সদস্যরা কফিনসহ লাশ কবর দেওয়ার কথা বলেন। মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। একজন মুসলমানকে ইসলামী বিধি বিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। সেনা অফিসাররা ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা হয়। তার বুকে ২৪টি গুলির চিহ্ন ছিল।
গুলি গুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। ডান হাতের তালুতে একটি গুলি। বাঁ পায়ের গোড়ার পাশে একটি এবং দুই রানের মধ্যখানে দুইটি গুলি। তখনও তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিল সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবি।পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ। আয়ূব মিস্ত্রীকে দিয়ে কফিন খুলিয়ে লাশ বের করে আনা হয়। আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে একটি ৫৭০ সাবান কিনে আনা হয়। এ সাবান দিয়ে মন্নাফ শেখ, সোনা মিয়া, ইমান উদ্দিন গাজী বঙ্গবন্ধুকে গোসল করান। টুঙ্গিপাড়া শেখ সাহেরা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিফের মাল শাড়ি আনা হয়। শাড়ির লাল ও কালো পাড় ছিঁড়ে ফেলে কাফনের কাপড় বানানো হয়। এ কাপড় পড়িয়ে জানাজা করা হয়।
যে জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানটি নিজের জীবনের ২৩টি বছর কেবল এ দেশের মানুষের অধিকারের জন্য কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন, তাঁর বিদায় হলো এমন করেই।