মুসলিম উম্মাহর জন্য মহররম এবং আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

উপ-সম্পাদকীয়/মতামত

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
আজ শুক্রবার ১৪৪৩ হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ।আরবি ‘আশারা’ শব্দের অর্থ দশ। আর আশুরা মানে দশম। ইসলামি পরিভাষায়, মহররমের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ফলে আশুরার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মহররম চান্দ্রবছরের প্রথম মাস, সম্মানিত চার মাসের তৃতীয়। ইসলামের ইতিহাসে মহররম অত্যন্ত ফজিলতময় মাস। মহররমের দশ তারিখে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলা হলেও বিশুদ্ধ বর্ণনায় মাত্র দু’টি ঘটনার কথা জানা যায়।এক. হজরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং তার সাথীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা। যেখানে দরিয়ায় রাস্তা বানিয়ে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।দুই. এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদের দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করার ঘটনা।এই দুই ঘটনা বিভিন্ন সহিহ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিমসহ হাদিসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।ইতিহাসে পাওয়া যায়, আশুরার দশ তারিখে অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের হাত থেকে আল্লাহতায়ালা বনী ইসরাঈলকে রক্ষা করেন। ফেরাউনের ওপর বিজয় দান করেন। এ জন্য দিনটিকে মুসলিম মিল্লাতের বিজয়ের দিন বলা হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর বনী ইসরাঈলকে আমি পার করে দিয়েছি নদী। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছে ফেরাউন ও সেনাবাহিনী, দুরাচার ও বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্যে। এমনকি যখন তারা ডুবতে আরম্ভ করল, তখন বলল, এবার বিশ্বাস করে নিচ্ছি যে, কোনো মাবুদ নেই তাকে ছাড়া যার ওপর ঈমান এনেছে বনী ইসরাঈলরা। বস্তুত আমি তারই অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। এখন একথা বলছ। অথচ তুমি ইতোপূর্বে নাফরমানি করেছিলে এবং পথভ্রষ্টদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলে। অতএব আজকের দিনে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পশ্চাদবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। আর নিঃসন্দেহে বহু লোক আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।’ -সূরা ইউনুস: ৯০-৯২ অনেক কিতাবে লেখা আছে, আশুরার দিনে কিয়ামত সংগঠিত হবে। কিন্তু এ কথার কোনো ভিত্তি নেই, নির্ভরযোগ্য কোনো বর্ণনায় এ কথার কোনো আলোচনা আসেনি। আবার কোনো কোনো রেওয়ায়েতে বলা হয়, আশুরার দিনে হজরত আদম আলাইহিস সালামের তওবা কবুল হয়েছে। এমনকি একথা আবুল কাসেম ইস্পাহানি (রহ.) কর্তৃক সংকলিত আত তারগিব ওয়াত তারহিবের ১৮৬৮ নম্বর রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু এই রেওয়ায়েতের সনদ খুবই দুর্বল। এ ছাড়া আরও কিছু রেওয়ায়েতে এই কথা এসেছে, সেগুলো মওযু তথা দুর্বল।অবশ্য কোনো কোনো তাবেয়ি থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তারা হজরত আদম আলাইহিস সালামের তওবা কবুল হওয়া সম্পর্কে আশুরার দিনের কথাই বলতেন।হজরত নূহ আলাইহিস সালামের কিশতি যেদিন জুদি পাহাড়ে থেমেছিল সেই দিনটি ছিল আশুরার দিন। এই রেওয়ায়েতও দুর্বল। তবে এটা ঠিক যে, একথা মুসনাদে আহমাদের একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু তার সনদ দুর্বল।আর হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম আশুরার দিন হয়নি। একথা প্রমাণিত নয়। আবুল কাসেম ইস্পাহানি (রহ.)-এর কিতাব আত তারগিব ওয়াত তারহিবের পূর্বোক্ত রেওয়ায়েতেই একথা এসেছে। আগেই বলা হয়েছে, এর সনদ খুবই দুর্বল।আরেকটি বিষয়। আমাদের দেশের সংবাদপত্র থেকে শুরু করে আশুরাকেন্দ্রিক যাবতীয় আলোচনায় শুধু কারবালার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। মনে হয়, আশুরায় শুধু কারবালার ঘটনাই ঘটেছে। আশুরা তাৎপর্যময় হয়েছে কারবালার কারণে। বিষয়টি কিন্তু তা নয়।হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির ১০ মহররমে কারবালায় হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা আশুরার দিনের সঙ্গে মিলে যাওয়া একটি ঘটনাবিশেষ। আশুরার আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিষয় নয়।কারণ হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের আগেই আমাদের শরিয়ত পূর্ণ হয়ে গেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই শরিয়ত পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহতায়ালা নিজে এই শরিয়ত, শরিয়তের দলিল ও দলিলের উৎসসমূহ হেফাজত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই শরিয়ত যেভাবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে আজ পর্যন্ত সেভাবেই সংরক্ষিত আছে। সে অনুযায়ী সবার আমল করা জরুরি। তাতে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই।অতএব হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরে সংঘটিত কোনো বিপদ বা আনন্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো দিন বা কোনো মাসের নতুন কোনো ফজিলত বা নতুন কোনো বিধান আবিষ্কার করা যাবে না। এগুলো ইসলাম সমর্থন করে না।
দুঃখ ও আনন্দ উভয়টির বিধান শরিয়তে আছে এবং তা নির্ধারিত। উম্মতের ওপর ওয়াজিব হলো সেই হুকুম অনুযায়ী আমল করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- বিপদ-আপদের সময় একজন বান্দার কী করণীয়, কী বর্জনীয় তার বর্ণনা আছে কোরআন-হাদিসে।কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা (তাদের জীবিত থাকার বিষয়টা) উপলব্ধি করতে পারো না। আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব (কখনও) কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, (কখনও) জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদেরকে, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। যারা কোনো মসিবত দেখা দিলে বলে ওঠে, আমরা সকলে আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে বিশেষ করুণা ও দয়া রয়েছে এবং এরাই আছে হেদায়েতের ওপর। -সূরা বাকারা: ১৫৪-১৫৭
এ আয়াতের আলোকে বুঝা গেল, কারবালায় হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা আমাদের জন্য বিপদ ও মসিবতের বিষয়। এক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের হুকুম হলো, বিপদগ্রস্ত লোকেরা সবর করবে। ইন্না লিল্লাহিওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়বে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে সওয়াবের আশা করবে।কারও ইন্তেকালে শরিয়তের হুকুম হলো সবর করা অর্থাৎ ধৈর্যধারণ করা। অধৈর্য হয়ে অভিযোগপূর্ণ কোনো কথা বলা, বিলাপ করা, হাত পা ও বুক চাপড়ানো, চেহারা খামচানো, শোকের পোশাক পরা ইত্যাদি হারাম। ইসলামি শরিয়তে খুব কঠোর ভাবে তা থেকে বারণ করা হয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি মুখে আঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে, জাহিলি যুগের (মতো) বিলাপ করে; সে আমাদের দলভুক্ত নয়। -সহিহ বোখারি: ১/১৭২ অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি ওই ব্যক্তি থেকে মুক্ত, যে শোকে মাথা মুণ্ডায়, বুক চাপড়ায় ও কাপড় ছিঁড়ে। -সহিহ মুসলিম: ১৬৭হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের পর থেকে তিন শ’ বছর পর্যন্ত ১০ মহররমে কান্নাকাটি, আহাজারি, চিৎকার ও বুক চাপড়ানো প্রথার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরিতে মুঈযযুদ দাওলা দাইলামি (একজন শিয়া) দশ মহররমে শুধু বাগদাদে হজরত হুসাইন (রা.)-এর জন্য মাতম করার হুকুম জারি করে। এরপর ৩৬৩ হিজরিতে মিসরেও এই হুকুম জারি করা হয়। সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে।পরিশেষে ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিধানগুলো মেনে চলতে হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন, দেখলেন মদীনার ইয়াহুদীরা আশুরার দিবসে রোজা পালন করছে। তাদেরকে রোজা রাাখার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা বললো, এই দিনটি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দিনে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) এবং তার সম্প্রদায় বনী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং তার উপর বিজয় দান করেছেন। আর তারই শুকরিয়া হিসেবে এদিনে মুসা (আ.) রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরাও এই দিনে রোজা রাখি।তখন রাসুল (সা.) বললেন মুসা (আ.) এর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার। তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং সাহাবিগণকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম : ২৬৫৩) তবে ইয়াহুদীরা আশুরা উপলক্ষে একদিন রোজা রাখে। তাদের রোজার সাথে যেন মুসলমানদের রোজার সাদৃশ্য না হয়, তাই মুসলমানরা আশুরার রোজার সাথে ৯ অথবা ১১ তারিখে আরো একটি রোজা বৃদ্ধি করে মোট দুইটি রোজা রাখবে।হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রমজানের রোজার পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হলো মহররমের রোজা। (তিরমিজি : ২৪৩৮)তাই আমাদেরকে ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন হওয়া ও হজরত হুসাইন (রা.)সহ সব মুসলমানের জন্য প্রার্থনা করা, ইসলামের স্বার্থে ধৈর্যধারণ ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। তাদের মনে রাখা উচি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এল আজ সেই মুহররম মাহিনা। ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনাকালীন সময়ে মহররম মাসের মর্যাদা রক্ষার তাওফিক দান করুন। আশুরার রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। বিগত এক বছরের সগিরাহ গোনাহ থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।


বিজ্ঞাপন

লেখক, এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
কো.চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যান সোসাইটি।