সন্তানের স্বাভাবিক পরিবর্তন গুলোর উপর নজর দিন
বিশেষ প্রতিবেদন : দেশে পাওয়া যাচ্ছে নতুন মাদক। এলএসডি, আইস, বা খাটের মতো ভয়ানক ক্ষতিকর মাদক জব্দ হওয়ার খবর মিলছে নিত্যনতুন ।
নতুন এসব মাদকে আসক্ত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। নতুন সব মাদকে আসক্তদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করাও কঠিন বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবারের সদস্যরা প্রথমে জানতে পারেন না। কিন্তু তাদের আচরণে দেখা যায় নানা পরিবর্তন।
মাদকাসক্ত না হলেও একই ধরনের অনেকগুলো আচরণ দেখা দিতে পারে তাদের মধ্যে। সেক্ষেত্রে সন্তান মাদকাসক্ত কিনা কীভাবে বুঝবেন। আচরণসহ বেশ কিছু মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন চিকিৎসকরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদক আসক্তি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মাদকাসক্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে মাদকাসক্তের প্রায় ৬৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী। আশঙ্কার কারণ হচ্ছে, এরমধ্যে সাত থেকে ১১ বছরের শিশু রয়েছে শুন্য দশমিক ২০ শতাংশ।
১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে দেড় শতাংশ। অর্থাৎ ১৮ বছর হওয়ার আগেই অনেক শিশু মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। দেশে বিভিন্ন ধরনের মাদকের সহজলভ্যতাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
আর সামাজিক ও ব্যক্তিগত হতাশা ও বন্ধু-বান্ধবের প্রভাবে কৌতুহলের বশে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে অনেক কিশোর ও তরুণরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন বলেন, শিশু, কিশোররা একটা সময় পর্যন্ত সাধারণ রুটিনের মধ্যে চলে। যখন দেখবেন সেই রুটিনটা ওলট-পালট হচ্ছে, বা তার নিজের ইচ্ছার বিষয়গুলো বেড়ে যাচ্ছে।
টাইম মতো ঘুমাচ্ছেনা, ঠিক মতো ঘুম থেকে উঠছেনা। পড়াশোনায় আগের মতো মনোযোগ দিচ্ছেনা। বিশেষ করে তার মেজাজ-মর্জিটা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায়। রাফ ব্যবহারটা বেড়ে যায় তখন।
এগুলো মাদকাসক্তের আলামত। তবে যেকোনও কিছুতে পরিবর্তন তো হতেই পারে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তো সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। কিন্তু যখন দেখবেন যে চাওয়া পাওয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ বুঝা যাবে, তখনই বুঝতে হবে তার মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে।
সেই পরিবর্তনটা কি নেশার কারনে হচ্ছে, নাকি অন্য কোনও মানসিক রোগের কারণে হচ্ছে, সেগুলো বের করা হচ্ছে আমাদের করণীয়। উলট পালট হলেই যে সে মাদকাসক্ত তা নয়।
মানসিক রোগের কারণেও অনেক সময় তার এসব পরিবর্তন হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে জরুরিভাবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
সুলতানা আলগিন আরও বলেন, আবার শুধু দেখা গেলো যে, তারা কথা বেশি বলতেছে। কেনাকাটা বেশি চাচ্ছে। এটা চাই, ওটা চাই। এটাও আরেকটা রোগের লক্ষণ।
আমরা মনে করছি যে নিশ্চয় টাকা পয়সা বেশি চাচ্ছে মানেই সে নেশা করে। এ ধরনের ভুলভাবে তাকে বিচার করলেও কিন্তু তাদের মনের ওপর প্রভাব পড়ে।
দেখা গেলো বাচ্চা রাগ হয়ে বলছে, যে আমাকে মিথ্যা বলছ তো তাহলে আমি সত্যি করেই এটা করে দেখাবো। এমন করেও কিন্তু ঝামেলাগুলো তৈরি হতে পারে।
যদি দৈনন্দিন কাজগুলোর মধ্যে বেশি পরিবর্তন দেখা যায় তাহলে ক্লোজ অবজারবেশনে রাখতে হবে। তার আশেপাশের বন্ধু-বান্ধব যারা আছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। কী করছে, সেগুলো খোঁজ নিতে হবে।
তিনি বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শের আগে বাবা মা বা স্বজনরা নিজেরা তাদের সঙ্গে নমনীয়ভাবে আলোচনা করতে হবে। সরাসরি অভিযুক্ত না করে তাকে বুঝাতে হবে। এগুলো ভালো না।সময় দিয়ে বুঝাতে হবে।
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হেলাল উদ্দিন আহমেদ গনমাধ্যমকে বলেন, মাদকাসক্ত হলে সন্তানদের চিন্তায় ও আচরণে পরিবর্তন দেখা দেবে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাদের রাত জাগা বেড়ে যাবে। দিনে দীর্ঘ সময় ঘুমাবে।
এটা একটা কমন আচরণ। তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। তারা রাগান্বিত হবে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করবে। সামাজিকভাবে তারা নিজেদের গুটিয়ে রাখবে। কোথাও যেতে চাইবে না।
পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে যাবে না। নিজের মতো করে ঘরে থাকার চেষ্টা করবে। বাথরুমে অনেকক্ষন থাকবে। ঘন ঘন মোবাইল ফোনের নাম্বার পাল্টাবে।
কারণে অকারণে টাকা চাইবে। টাকা না পেলে তারা বাড়িতে রাগারাগি করবে। একসময় টাকার জন্য তারা ঘরের জিনিসপত্র বাইরে বিক্রি করে দিবে।
ডাক্তার হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, তাদের দৈহিক কিছু পরিবর্তন হবে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হবে। খেতে চাইবে না। চেহারা খারাপ হয়ে যাবে। চোখ লাল থাকবে। নিজের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিবে। বন্ধু-বান্ধবের পরিবর্তন হবে। নতুন বন্ধু বান্ধব তৈরি হবে।
আগের বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক নস্ট হবে। হাত কাঁপবে। কথাবার্তা অসংলগ্ন বলবে। এ ধরনের সমস্যা তাদের মধ্যে দেখা দিবে। এসব আলামত দেখে আমরা বুঝতে পারি তাদের মধ্যে মাদকাসক্তের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে প্রতিকারের উপায় বের করতে হবে। সেটা হচ্ছে, সন্তান যদি সত্যিই মাদকাসক্ত হয়ে যায় তাহলে একমাত্র উপায় হচ্ছে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। যত দ্রুত সম্ভব তাকে চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে নিতে হবে। তাহলে সে সুস্থ থাকবে।
আর যদি মাদকাসক্ত না হয়, কিন্তু এসব আলামতের অনেক কিছু দেখা যায়, সেক্ষেত্রে তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। না বলা শেখাতে হবে। বন্ধুদের চাপের কাছে সে যেন পরাজিত না হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যাতে সময় দেয়। খেলাধুলা বাড়াতে হবে।
শারীরিক খেলাধুলায় সম্পৃক্ততা থাকবে। ধূমপান করবে না। এ বিষয়গুলো তাকে মাদক থেকে প্রতিরোধ করতে পারে।