নিজস্ব প্রতিনিধি : আজ থেকে প্রায় ০৬ বছর আগে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসের ট্রাঙ্কে এক অজ্ঞাতনামা মহিলার লাশ পাওয়া যায়। ঘটনার তারিখ ০৩/০৫/২০১৫ ইং সকাল ০৯:০০ টার সময় চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট কেটে একজন ব্যক্তি একটি ট্রাঙ্ক তুলে দেয় বাসের বক্সে। বাসের হেলপারকে বলে সামনের ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে উক্ত টিকেটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে বর্ণিত যাত্রী না উঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে এবং বিকেল ০৫:৪৫ ঘটিকা নাগাদ গাবতলীতে পৌঁছায়। শেষ গন্তব্যে সকল যাত্রী যে যার মতো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। পরবর্তীতে হেলপার দেখে একটি ট্রাঙ্ক বাসের বক্সে মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসের ড্রাইভার হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি নামিয়ে দেখে এটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুসসালাম থানায় খবর দিলে থানা পুলিশ হাজির হয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুনীর লাশ দেখতে পান। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে পোস্টমর্টেম এর জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করেন। লাশের পরিচিতি শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। কেউ বাদী না হওয়ায় থানা পুলিশের পক্ষে এসআই জাহানুর আলী বাদী হয়ে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে দারুস সালাম থানার মামলা নং-০৬ তারিখ ০৩/০৫/২০১৫ ইং, ধারা ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড দাখিল করেন।
মামলাটি রুজু হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ তদন্ত করে। থানা পুলিশের পরে সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে। দাখিলকৃত চূূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দিলে পিবিআই ডিআইজি জনাব বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএম মহোদয়ের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) উক্ত মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।
পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) এর ইউনিট ইনচার্জ জনাব মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, বিশেষ পুলিশ সুপার এর তত্ত্বাবধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর জনাব আশরাফুজ্জামান ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সকল পদ্ধতি প্রয়োগ করে। ডিআইজি পিবিআই মহোদয়ের বিশেষ নির্দেশনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে স্ব-শরীরে চট্টগ্রাম মেট্রো এবং জেলা এলাকার সকল থানায় বিগত ২০১৫ সালে এন্ট্রিকৃত নিখোঁজ জিডিসমূহ অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা এক সপ্তাহ নিরলস পরিশ্রম করে ঐ সময়ে কাছাকাছি প্রায় দশ বারোটি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করে। উক্ত জিডিগুলোর মধ্যে জিডি নং-৫৯৯ তারিখ ১০/০৬/২০১৫ ইং মূলে দেখা যায় শম্পা বেগম, পিতা ইলিয়াস শেখ, গ্রাম: দেওয়ানা উত্তরপাড়া, থানা: দৌলতপুর, খুলনা উক্ত তারিখে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। উক্ত ঘটনা সংক্রান্তে ভিকটিম শম্পা বেগম এর ভগ্নিপতি জনাব আব্দুল মান্নান বিগত ১০/০৬/২০১৫ তারিখে পাহাড়তলী থানায় উক্ত জিডিটি করেন।
উক্ত জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিডি রুজুকারী ভিকটিমের ভগ্নিপতি জনাব আব্দুল মান্নান এবং ভিকটিম শম্পা বেগমের বাবা জনাব ইলিয়াস শেখ (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) এর সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, বিগত ২০১৩ সালে জনৈক রেজাউল করিম স্বপন (অবসরপ্রাপ্ত নৌ বাহিনী সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালীন ভিকটিম শম্পা বেগম হাসপাতালে মেডিকেল এ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাজ করতেন। হাসপাতালে জনাব ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসাকালীন তার মেয়ে শম্পা বেগমের সাথে আসামি রেজাউলের পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম এবং পরে ভিকটিম তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে সে বদলী হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। এরপর ভিকটিম শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে আসে। চট্টগ্রামে ভিকটিম এর এক ফুফুর বাসায় কিছুদিন থাকে। এরপর ফয়েজ লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করে। পরবর্তীতে পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে বসবাস শুরু করে। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত একত্রে বসবাস করে। এখানে উল্লেখ্য যে তারা স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও বিবাহ করেনি।
পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এসব বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে আসামি রেজাউল করিম স্বপন শম্পাকে গত ০২/০৫/২০১৫ ইং তারিখে গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ^াসরোধ করে হত্যা করে। আসামি লাশ গোপন করার উদ্দেশ্যে একটি ট্রাঙ্কে ভর্তি করে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেয় এবং সুচতুরভাবে ভিকটিমের বাবাকে জানায়, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ভিকটিম তার বাবার বাড়িতে না পৌঁছলে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ভিকটিমের ভগ্নিপতি জনাব আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় বর্ণিত নিখোঁজ জিডিটি করেন। ভিকটিমের বাবা পরবর্তীতে ২৭ মার্চ ২০১৫ তারিখে আসামি রেজাউল করিম এর বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গোপন তদন্তের ভিত্তিতে জানা যায়, উক্ত আসামীকে তার বাহিনী কর্তৃক তদন্তে বিভিন্ন অপরাধ সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়েছে।
উক্ত মামলাটি রুজু হওয়ার পরে দারুসসালাম থানা পুলিশ প্রায় ৩ (তিন) মাস তদন্ত করে। এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে সিআইডি প্রায় ০৪ (চার) বছর তদন্ত করে লাশ সনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য আদালতে দাখিল করলে আদালত মামলাটি লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর হওয়ায় রহস্য উদঘাটনের স্বার্থে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিলে পিবিআই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই এর একটি চৌকসদল নিরলসভাবে পরিশ্রম করে ভিকটিমের পরিচয় সনাক্ত ও মূল আসামী রেজাউল করিম স্বপনকে গত ২৪/০৯/২০২১ তারিখ ভোরে কুমিল্লা জেলার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা হতে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। উক্ত আসামী ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রদান করেছে।
আজ দুপুর ১২ টায় পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স, ধানমন্ডিতে ব্রিফ করেন পিবিআই ডিআইজি জনাব বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার)। উপস্থিত ছিলেন, এসপি প্রশাসন, মোঃ ইকবাল, পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) এর ইউনিট ইনচার্জ জনাব মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।