মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ওয়েসিস’র পথচলা শুরু

অপরাধ

নিজস্ব প্রতিনিধি : রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার পথ। বুড়িগঙ্গা সেতু পার হলেই শান্ত-স্নিগ্ধ এক মনোরম স্থান। চারদিকে গাছপালায় ঘেরা সবুজ বনানী। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে এমনই এক নয়নাভিরাম নির্মল পরিবেশে পথচলা শুরু করলো মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’।


বিজ্ঞাপন

মাদকাসক্তদের সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটলো ওয়েসিস’র।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রধান অতিথি হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার সকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ওয়েসিস’ উদ্বোধন করেন।

ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোঃ আজিজুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রব্বানী, ডা. অরূপ রতন চৌধুরী ও ডা. মোহিত কামাল এবং ঢাকার জেলা প্রশাসক মোঃ শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।

বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিগণ, ঢাকাস্থ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানগণ, চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে মাদক তৈরি হয় না। কিন্তু আমরা এর ভয়াবহতার শিকার। মাদক থেকে যদি যুবসমাজকে বিরত না রাখি তাহলে এর পরিণতি কী হবে তা আমরা দেখেছি।

তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা সবাই জঙ্গি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে সফল হয়েছি। এখন মাদকের বিরুদ্ধেও আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, যারা মাদকাসক্ত তাদের কি হবে? আমরা তাদেরকে চিকিৎসা দিতে চাই, সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। তিনি বলেন, পরিবারের কোন সদস্য মাদকাসক্ত হলে তা গোপন না করে যথাযথ চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য তিনি পরিবারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

মন্ত্রী বলেন, মাদকের সরবরাহ, চাহিদা এবং এর ক্ষতি হ্রাস করার জন্য আমরা কাজ করছি। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ওয়েসিস স্থাপনের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তিনি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানান।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান আইজিপি বাংলাদেশ পুলিশকে একটি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। পুলিশ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন এবং সমাজে নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখছে। তিনি বলেন, করোনা মোকাবেলায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে পুলিশ।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপু মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় এ ধরনের একটি আধুনিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করায় বর্তমান আইজিপির গতিশীল নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, মাদকাসক্তদের রোগের নিরাময় করলেই হবে না। এর সাথে সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করা পুলিশের দায়িত্ব নয়। তবুও পুলিশ ওয়েসিস এর মত একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করায় আইজিপিকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

সভাপতির বক্তব্যে আইজিপি ওয়েসিস গড়ার উদ্যোগে শামিল হওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেন, ধনী-গরীব নির্বিশেষে মাদকাসক্ত সদস্যদের নিয়ে পরিবারের দুর্ভোগের ভয়াবহ করুণ চিত্র আমি দেখেছি। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের গোপনে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি। আবার অনেকের মতে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখ। কেউ কেউ বলেন এ সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। এদের চিকিৎসায় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাত হাজারের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাহলে কত বছরে আমরা তাদের চিকিৎসা দিতে পারবো। এসব দিক বিবেচনা করেই আমরা একটি আধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

তিনি বলেন, আমরা ভবিষ্যতে মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদীর তীরে বিশাল এলাকায় পাঁচ শ’ থেকে এক হাজার বেডের এ ধরনের হাসপাতাল করতে চাই। এক্ষেত্রে আমরা একটা রিজিওনাল হাব করতে চাই।

আইজিপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ‘মডেল’ হতে পেরেছি। এক্ষেত্রেও আমরা ‘মডেল’ হতে পারব। এক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদানের জন্য তিনি বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।

তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ ধনী দেশে উন্নীত হবে। যদি আমাদের যুব সমাজ মাদকের করাল গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে দেশের নেতৃত্ব দেবে কে?

আইজিপি বলেন, আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর হেলথ ট্যুরিজমে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়। আমরা যদি বিশেষায়িত হাসপাতাল করে বিদেশ থেকে এক্সপার্টদের নিয়ে আসতে পারি তাহলে আমাদের এই অর্থ দেশেই থাকবে। দেশে এক্সপার্ট তৈরি হবে। পরে আর বিদেশী এক্সপার্টের প্রয়োজন হবে না।

করোনায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে পুলিশ বাহিনীর অনন্য অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনাকালে দেশ ও জাতির কল্যাণে ১০৬ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে সাধারণ হাসপাতাল থেকে কোভিড হাসপাতাল উন্নীত করেছি। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে শুধু পুলিশ সদস্যদেরই নয়, দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষকে করোনার চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল পুলিশ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার প্রশংসা করেছে। করোনার টিকা প্রদানের ক্ষেত্রেও পুলিশ হাসপাতাল অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আইজিপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়ার জন্য আমাদের সবাইকে একই লক্ষ্যে ধাবিত হতে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও ওয়েসিস পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হাবিবুর রহমান মাদককে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, সামাজিকভাবেই এর সমাধান করা প্রয়োজন।

ওয়েসিস স্থাপনের পটভূমি তুলে ধরে তিনি বলেন, মাদকের ভয়াবহ ছোবলে পড়ে আমাদের তরুণ সমাজের অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তাদেরকে মাদকমুক্ত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার মানসে আইজিপি মহোদয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে আমরা ওয়েসিস প্রতিষ্ঠা করেছি।

মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সাততলা ভবনের ষাট শয্যার ওয়েসিস এ বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট এবং অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কাউন্সেলরগণের মাধ্যমে বিশ্বমানের সমন্বিত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে।
এখানে পুরুষ এবং মহিলা রোগীর জন্য পৃথক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।

ওয়েসিস এ চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তদারকি, স্বতন্ত্র কাউন্সেলিং সেশন, উন্নতমানের শরীর চর্চা কেন্দ্র, বিনোদন সুবিধা, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও জীবনধর্মী শিক্ষামূলক নানা আয়োজনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

মাদকাসক্তদের সুচিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ‘ওয়েসিস’ যেন সত্যিকার অর্থেই মরুভূমিতে এক মরুদ্যান।