বিশেষ প্রতিবেদক : আল-আমিন (ছদ্মনাম)। প্রবাসে আছেন পাঁচ বছর হয়ে গেল, বয়স অনুমানিক ৩৫ বছর। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে নিজের পরিবার পরিজন থেকে অনেক দূরে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা কষ্টের পরে যখন বাসায় ফিরে আসে তখন আর করার তেমন কিছুই থাকে না।
এমনি একদিন মোবাইল ফোন চালাতে চালাতে নোটিফিকেশন আসে লাইভ স্ট্রীমিং প্লাটফর্ম Bigo Live এর, কৌতুহলবশত Bigo Live এ্যাপসটি ডাউনলোড করে আল-আমিন।
প্রবাসী একাকী জীবনে আল-আমিন Bigo Live এর বিভিন্ন নারীদের লাইভ স্ট্রিমিং এ ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। যে কষ্টার্জিত টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার কথা দেশে ফেলে আসা পরিবারের কাছে।
দেশে টাকা না পাঠিয়ে সেই টাকা দিয়ে ভার্চুয়াল কারেন্সি ‘‘ডায়মন্ড’’ কিনে গিফট করে লাইভ স্ট্রিমার বান্ধবীদের, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী/অশালীনআচরণ/নাচগানে বুঁদ হয়ে থাকে আল আমিন।
স্ত্রীর বারংবার টাকা পাঠানোর অনুরোধ, ছেলের কান্না সবকিছু উপেক্ষা করে কষ্টার্জিত সকল টাকা দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে লক্ষ টাকার ডায়মন্ড কিনে আল-আমিন। ধীরে ধীরে নিজের পরিবারের কথা ভুলে অনলাইনরে এই মায়াজালে আটকা পরে আল আমিন।
.
দেশের উঠতি বয়সের যুবকরা যে বয়সে নিজেকে আগামী পৃথিবীর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কথা, তা না করে জড়িয়ে পড়ছে Bigo Live এবং Likee এর মতো লাইভ স্ট্রিমিং এ্যাপসের মিথ্যা মায়াজালে।
ভার্চুয়াল করেন্সী ডায়মন্ড কিনে হচ্ছে সর্বস্বান্ত। দেশের যুব সমাজ জড়িয়ে পড়ছে যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। সমাজে দেখা দিচ্ছে চরম নৈতিক অবক্ষয় ও বাড়ছে পারিবারিক অশান্তির বাতাবরণ।
.
আপাত দৃষ্টিতে Bigo Live এবং Likee এই লাইভ স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোকে নিছক বিনোদনের মাধ্যম বলে মনে করা হলেও বিনোদনের আড়ালে লুকিয়ে আছে অশ্লীলতা। যারা যুবসমাজকে টার্গেট করে তাদের নৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এজেন্টের মাধ্যমে কম বয়সী নারী সংগ্রহ করে।
যাদের কাজ হচ্ছে অশালীনতার সর্বনম্নি পর্যায়ে গিয়ে অশ্লীল নাচ গান,দেহ ভঙ্গি করে উঠতি বয়সের যুবকদের এবং নিঃসঙ্গ প্রবাসীদের আড্ডা দেওয়ার প্রলোভনে তাদের কাছ থেকে কয়েন সদৃশ ডায়মন্ড গিফট নেয়া।
সাপোর্টার /সেন্ডার আইডি খুলে যুবকরা ডায়মন্ড গিফট করে ব্রডকাস্টার এসব মেয়েদের, চলে অনলাইন চ্যাটিং, ভিডিও শেয়ারিং, গড়ে ওঠে অনৈতিক সম্পর্ক।
মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ছে এবং সমাজে নৈতিক অবক্ষয় চরম রূপ ধারন করছে। আর এর পিছনে আছে বাংলাদেশী বিভিন্ন এজেন্সি। যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করে পরস্পরের সাথে।
এই ডায়মন্ড সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন এজেন্সী। এ সকল এজেন্সীর প্রত্যেকের রয়েছে একাধিক পেমেন্ট গেটওয়ে।
সাধারণত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সকল এজেন্সীর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীগণ এ সকল এজেন্সীর পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদান করে এ সকল ডায়মন্ড ক্রয় করে থাকেন।
লক্ষাধিক বাংলাদেশি ব্যবহারকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনলাইন ব্যাংকিং, হুন্ডি, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও ব্যাংকের মাধ্যমে এই ডিজিটাল মুদ্রা কিনছে।
এজেন্সিগুলো ডায়মন্ড কিনে আনে অ্যাপের বিদেশি অ্যাডমিনদের কাছ থেকে আর এই ডায়মন্ড কেনার জন্য এ সকল এজেন্সীগুলো বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাঁচার করে যাচ্ছে।
.
ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিং এ্যাপস Bigo Live এবং Likee মোবাইল ব্যাংকিং, হুন্ডি, অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এই মডারেটর এজেন্সিগুলো অবৈধভাবে কোটি টাকা টাকা পাচার করছে বিদেশে ’’ এ রকম একটি অভিযোগ আছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের কাছে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের কাছে অভিযোগ আসার পর তাৎক্ষনিকভাবে তৎপর হয়ে অনুসন্ধান চালায় সিআইডির সাইবার পুলিশের টিম।
Bigo Live এবং Likee এর পরিচালনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১২ অক্টোবর অভিযান পরিচালনা করে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ১জন বিদেশী নাগরিকসহ মোট ৫ (পাঁচ) জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন মোস্তফা সাইফ রেজা (২৬), মোঃ আরিফ হোসেন (২৭), এস এম নাজমুল হক (২৭) এবং আসমা উল হুসনা সেজুতী (২৮) ও অজ্ঞাত বিদেশী নাগরিক।
.
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত বিদেশী নাগরিক Bigo Live এর কান্ট্রি ডিরেকটর। বাংলাদেশী নাগরিক মোস্তফা সাইফ রেজা (২৬) Bigo Live এর বাংলাদেশী এডমিন।
মোঃ আরিফ হোসেন (২৭) বাংলাদেশে বিভিন্ন মেয়েদের রিক্রুট করে এই বিগো লাইভের সাথে যুক্ত করতেন। এস এম নাজমুল হক (২৭) ভার্চুয়াল মুদ্রা ডায়মন্ড বিক্রির অন্যতম প্রধান বাংলাদেশী এজেন্ট, আসমা উল হুসনা সেজুতী (২৮) Bigo Live এর প্রধান এডমিন। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্ণোগ্রাফী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
.
গ্রেফতারকৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেকের নাম এসেছে এবং তাদের বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস একাউন্টে গত এক বছরে প্রায় শত কোটি টাকারও বেশি লেনদেন এর তথ্য পাওয়া যায়।
.
গ্রেফতারকৃতদের নিকট থেকে ৬টি মোবাইল ফোন, ৫টি ল্যাপটপ, ১টি প্রাইভেটকার, বিভিন্ন ব্যাংকের ৭টি ক্রেডিট কার্ড, বিভিন্ন ব্যাংকের ৬টি চেক বই, নগদ ৫০,৪৬০/- টাকা উদ্ধার করা হয়।
এ অভিযানের বিষয়ে প্রচুর শুভাকাঙ্খী এবং গণমাধ্যমকর্মী তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় আগত গুরুত্বপূর্ণ খবর আমাদের এ অভিযানে সহায়তা করেছে।
সাইবার অপরাধ সংক্রান্তে যেকোন তথ্য দিয়ে আমাদের সহযোগীতা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।