ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ

এইমাত্র জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন

মন্তব্য প্রতিবেদন


বিজ্ঞাপন

 

আমিনুর রহমান বাদশা : পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনার নজির নেই। স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী, রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার প্রধানকে হত্যার নজির আছে; কিন্তু রাতের অন্ধকারে পরিবারের সব সদস্যকে একযোগে হত্যা হায়েনার দল ছাড়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা আরও গুরুতর অপরাধ করেছিল ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়ে, কুখ্যাত ইনডেমননিটি অধ্যাদেশ জারি করে।

১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই তৎকালিন অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী জিয়াউর রহমান হাস্যকর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়ে জাতীয় সংসদে মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে কালো আইনে পরিণত করে। এ আইনে বলা হয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতার হত্যার বিচার চাওয়া যাবে না। এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেন কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজ।

রক্তের দাগ তখনও শুকায়নি। জাতির পিতাকে হত্যার ৪২ দিনের মাথায়, ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনি খোন্দকার মোশতাক। অধ্যাদেশে যে কোনো আদালতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। যেহেতু তখন সংসদ অধিবেশন ছিল না, সেহেতু ১৯৭৫ সালের এই দিনে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখলকারী খুনী মোশতাক আহমেদ একটি অধ্যাদেশ আকারে ইনডেমনিটি জারি করেন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল।

ইনডেমনিটি শব্দের অর্থ “শাস্তি এড়াইবার ব্যবস্থা”, অর্থাৎ, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হল সেই অধ্যাদেশ যার মাধ্যমে শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গকে হত্যার পেছনে যারা জড়িত ছিল, তাদের শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এই অধ্যাদেশটি জারি করা হয়।

অবৈধ রাষ্ট্রপতি মোশতাক কর্তৃক খুনীদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ছিল দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান পরিপন্থী। খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর থাকলেও এই অধ্যাদেশ জারির নেপথ্যের কারিগর ও মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জেনারেল জিয়া, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিনের মাথায় তৎকালীন সেনাপ্রধানকে হটিয়ে নিজেই সেনাপ্রধান বনে যান। সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ জবরদখলকারী মোশতাকের প্রতি স্বঘোষিত সেনাপ্রধান জিয়ার আনুগত্য প্রকাশ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট করে। সেনাপ্রধান হিসেবে সংবিধান সমুন্নত রাখা, রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য দেখানো তার সাংবিধানিক ও গৃহীত শপথের কর্তব্য ছিল। কিন্তু তিনি অবৈধ রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য এবং অবৈধ রাষ্ট্রপতির বেআইনী অধ্যাদেশ প্রণয়নে ভূমিকা ও সমর্থনের দ্বারা অসাংবিধানিক কাজ করেন। খন্দকার মোশতাককে ৮২ দিন পুতুল রাষ্ট্রপতি রেখে নতুন অধ্যায়ের অবতারণা করে বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েমকে বেআইনীভাবে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। আইন অনুযায়ী অসাংবিধানিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হবার কোন সুযোগ ছিল না বিচারপতি সায়েমের। ৮ নবেম্বর তাকে রাষ্ট্রপতি এবং সঙ্গে চীফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর করা হয়। যদিও বাংলাদেশে এরূপ কোন পদের আইনগত অস্তিত্ব নেই। জিয়া হয়ে যান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। বাংলাদেশের সংবিধানে বা অন্য কোন আইনে এরূপ কোন পদের অস্তিত্ব নেই।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি, উক্ত অধ্যাদেশকে জিয়ার নিজ স্বাক্ষরে ১৯৭৯ সালে আইনে পরিণত করা হয়। নিজে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক নেতাদের মতো ভোটের আয়োজন ও প্রার্থী হওয়া, ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা যাবে না – এমন বিধান করা এবং এর সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী হওয়া সবই ছিল জঘন্যতম অপরাধ ও সংবিধানের চরমতম লঙ্ঘন। এছাড়া অপরাধ করে কিছুই হবে না- এমন মানসিক ধারণা থেকে অপরাধপ্রবণতা বাড়তেই থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার না করায় বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া, খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহেরসহ অনেককে বিচার বহির্ভূত উপায়ে জীবন দিতে হয়েছে নির্মম হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে।
জিয়ার বর্বর মানসিকতার কারণে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস জিয়াকে সাইকো কিলার বলেছেন। অনেকে তাকে সিরিয়াল কিলার হিসাবেও সম্বোধন করে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিলের মাধ্যমে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি খুনিদের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আরো এক জন দণ্ডিতকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে; অবসান হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গ্লানি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ।