এফআর টাওয়ার কেলেঙ্কারি
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বনানীনতে ফারুক-রূপায়ন টাওয়ার (এফআর টাওয়ার) নির্মাণ তদারকিতে দুর্নীতির অভিযোগে আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এর ৩ নম্বর মামলা অনুযায়ী বিচারিক আদালতে ওই আট জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ হয়েছে। দুদকের মামলায় ওই আট জনের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বরখাস্ত হওয়া আট জন হলেন রাজউকের জোন-২-এর সহকারী অথোরাইজড অফিসার নজরুল ইসলাম, নিরীক্ষা ও বাজেট শাখার সহকারী পরিচালক সদরুল আমিন, প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদউজ্জামান, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মুজিবুর রহমান মোল্লা, এস্টেট পরিদর্শক মো. মোফাজ্জেল হোসেন, উচ্চমান সহকারী মো. সাইফুল আলম, প্রধান ইমারত পরিদর্শক ইমরুল কবির এবং উচ্চমান সহকারী মো. শফিউল্লাহ।
রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর সই করা এক আদেশে বরখাস্ত করা হয়েছে এই আট জনকে। আদেশে রাজউক চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন, এ বছরের ১৬ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২১.৫৭৩ নম্বর স্মারক এবং ৭ অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২১.২৬৯ ও ২১.২৭০ স্মারক অনুযায়ী ওই আট জনকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বরখাস্ত আদেশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি চাকরিবিধি ২০১৩-এর ৪৩ (৪) ধারা অনুযায়ী বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা খোরাকি ভাতা পাবেন।
আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম নুরী বলেন, ‘বরখাস্তের তথ্যটি সঠিক আছে।’ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার প্রক্রিয়া বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদেশে সই হওয়ার দিন থেকেই বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রসিকিউশন শাখা এ বিষয়ে নথি প্রস্তুত ও মামলা দায়েরের বাকি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে।’
বরখাস্ত হওয়ার বিষয়ে তৎকালীন প্রধান ইমারত পরিদর্শক নজরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তিনি সংযোগ কেটে দেন। এরপর একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও তার কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়লে ২৬ জন মারা যান। ওই ঘটনায় অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হন। এরপর ওই টাওয়ার নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
দুদকের পাশাপাশি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ও ঘটনার তদন্ত শুরু করে। অগ্নিকা-ের পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয় এফআর টাওয়ারের ১৮ তলার নকশা অনুমোদন করা হয়েছিল বিধি লঙ্ঘন করে। তার ওপরে আরও পাঁচটি ফ্লোর নির্মাণের নকশাকে বৈধতা দিতে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি হয়। নিয়মের লঙ্ঘন ছিল ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রেও।
এ মামলায় ভুয়া ছাড়পত্রের মাধ্যমে এফআর টাওয়ারের ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা নির্মাণ, বন্ধক প্রদান ও বিক্রি করার অভিযোগে দ-বিধির সাতটি ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫ (২) ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
আরেক মামলায় এফআর টাওয়ারের ১৫ তলা অনুমোদন থাকলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬ লঙ্ঘন করে নকশা জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় দ-বিধির চারটি ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় মোট পাঁচ জনকে আসামি করা হয়েছিল। আসামিরা হলেন— এফআর টাওয়ারের মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ূন খাদেম, রূপায়ণের লিয়াকত আলী খান মুকুল, রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান ও সাবেক অথোরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহমেদ।
জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন ১৯৯৬ সালে তার মালিকানাধীন ১০ কাঠা জায়গাতে ১৮ তলা ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকে আবেদন করেন। প্রথমে ১৫ তলার অনুমোদন পেলেও পরবর্তীকালে রাজউকের সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে অবৈধভাবে ১৮ তলা ভবন নির্মাণ করেন। আরও পরে ভবনটি অবৈধভাবে ২৩ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়।
রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারের নকশা জালিয়াতি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিলের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। একইসঙ্গে এজাহারভুক্ত সাত আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন পাঁচ জনকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ নাজমুল হুদা মৃত্যুবরণ করায় তাকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়। এছাড়া অব্যাহতিপ্রাপ্তরা হলেন— রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান কে এ এম হারুন, সাবেক সদস্য মো. রেজাউল করিম তরফদার, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব আ ই ম গোলাম কিবরিয়া, সাবেক প্রধান ইমারত পরিদর্শক মো. মাহবুব হোসেন সরকার, সাবেক ইমারত পরিদর্শক মো. আওরঙ্গজেব সিদ্দিকি ও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সামছুর রহমান।
অন্যদিকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত নতুন আসামিরা হলেন— রাজউকের উচ্চমান সহকারী মো. সাইফুল আলম, ইমারত পরিদর্শক ইমরুল কবির, ইমারত পরিদর্শক মো. শওকত আলী, উচ্চমান সহকারী মো. শফিউল্লাহ ও সাবেক অথোরাইজড অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম।
দুদক সূত্র জানায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন স্থাপনার নকশা সংক্রান্ত রাজউক অনুমোদিত মোট ৫৭টি নথি গায়েব/বিনষ্ট করার অভিযোগ দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়। ফলে দ-বিধির ২০৪/২১৭ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় পৃথক দু’টি মামলার অনুমোদন দেয় সাংবিধানিক সংস্থাটি।
দুদকের উপসহকারী পরিচালক খন্দকার আখেরুজ্জামান এই অভিযোগ অনুসন্ধান করেন। এছাড়া অনুসন্ধানটি তদারকি করেন দুদকের উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমান।