নীলফামারীতে ১২টি অরক্ষিত রেলক্রসিং

বিশেষ প্রতিবেদন

চলতি বছরে ৫০ মৃত্যু


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : নীলফামারী জেলা রেলওয়ের ১২টি অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। ঝরছে প্রাণ। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। দীর্ঘদিন এসব রেলক্রসিং অরক্ষিত থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি রেলওয়ে বিভাগ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ জন।
রেলওয়ে বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ডোমার উপজেলার চিলাহাটি থেকে সৈয়দপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত ৩৩টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি অরক্ষিত। ১২টির মধ্যে তিনটি অবৈধ। বাকি ২১টিতে গেটম্যান রয়েছেন।
৮ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে নীলফামারী সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের মনসাপাড়া বউ বাজার গ্রামে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে তিন শিশুসহ চার জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- ওই গ্রামের রিকশাচালক রেজোয়ান আলীর তিন সন্তান যথাক্রমে, শিমু আকতার (১০), লিমা আকতার (৮) ও মমিনুর রহমান (৩) এবং একই গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে শামীম হোসেন (৩০)। একই স্থানে এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, অরক্ষিত এসব রেলক্রসিংয়ে ঘটছে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা। নেই ট্রেন ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কর্মী, নেই সংকেত বাতি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে ৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের সবাই পথচারী ও শিশু। এসব দুর্ঘটনার পরও গেটম্যান দেওয়া হয়নি।
জেলা সদরের চেতাশাহ রেলগেটের পাশেই বসবাস করেন মো. জহুরুল হক শাহ। তিনি বলেন, ‘এখন রেলক্রসিংয়ে যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে রেল বিভাগের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাই রেলপথ ও সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চেতাশাহ রেলগেটে কয়েকবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজনের প্রাণ গেছে। এ অবস্থায় দেড় বছর আগে গেটকিপার নিয়োগ করা হয়। এতে কমেছে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা।’
একই এলাকার হাড়োয়া খানকা শরিফ সংলগ্ন রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় পথচারী আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, ‘এই রেলক্রসিংয়ে গেটকিপার নেই। এই পথ দিয়ে হাড়োয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মহিলা মাদ্রাসা, হাড়োয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা চলাচল করে। সেই সঙ্গে মানুষও চলাচল করে। সবাই ঝুঁকি যাতায়াত করেন। অথচ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ। মানুষের জনমাল রক্ষার্থে এখানে গেটকিপার দেওয়ার দাবি জানাই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দপুর রেলওয়ের পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিলে রেলপথের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে মানুষকেও রাস্তা পারাপারে সচেতন হতে হবে। মানুষ সচেতন না হলে যানবাহন ও রেলের গতি বাড়ানো সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগ সড়ক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অধীনে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের উদ্যোগ নেই। এ জন্য অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের একটা বড় অংশই অরক্ষিত। অবৈধগুলোর কথা না-ই বললাম।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ক্রসিংয়ের উন্নয়নে প্রকল্প হাতে নেয় ২০০৯ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদন পেতে সময় লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। অবশেষে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি।
নীলফামারী পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, গেট আর কর্মী নিয়োগের পরও ট্রেন আসার আগমুহূর্তে পথচারীদের মধ্যে তড়িঘড়ি করে পারাপারের প্রবণতা দেখা যায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি পথচারীদেরও দেখেশুনে পথচলা জরুরি।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে মানুষের প্রাণহানি নিয়ে রেলের দায়বদ্ধতা নেই। যানবাহন চলাচলের কারণে রেললাইন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য যানবাহন ও মানুষ পারাপারের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ একটি সতর্কবাণী সংবলিত সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। এতে তাদের দায়িত্ব শেষ।
সরেজমিন দেখা যায়, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে যেসব সাইনবোর্ড রয়েছে, সেখানে লেখা রয়েছে, ‘এই গেটে কোনও গেটম্যান নেই, পথচারী ও সব প্রকার যানবাহনের চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার হবেন। যেকোনও দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন।’ আবার অন্য সতর্কবার্তা দেখা যায়। যেখানে লেখা, ‘এই স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।’
রেলওয়ের পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান বলেন, অনুমোদিত রেলক্রসিংগুলোতে কর্মী নিয়োগসহ কিছু কিছু ক্রসিংয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অননুমোদিত রেলক্রসিং নিয়ে আমাদের তেমন কিছুই করার নেই।
রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, রেলগেটে সতর্কবার্তা ও সাবধানতা বাণী দেওয়া রয়েছে। এটি দেখে পথচারীদের চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেললাইনের দুই পাশে বসবাসকারীদের নানা ধরনের পরামর্শ দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।