নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে পুরান ঢাকার লালকুঠি হতে রূপলাল হাউজ পর্যন্ত অংশের সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল অতিসত্বর সরিয়ে নিতে আহবান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ঢাদসিক) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফলজে নূর তাপস।
সোমবার (২৩ মে) দুপুরে সদরঘাটস্থ লালকুঠি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্ট (DCNUP) প্রকল্পের আওতাধীন প্রকল্প কার্যাবলী সংক্রান্ত প্রদর্শনী কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বিআইডব্লিওটিএ-কে এই আহবান জানান।
ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “বুড়িগঙ্গা নদী ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে আমাদের ঢাকা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা এই ঐতিহাসিক স্থাপনা হতে এখন আর বুড়িগঙ্গা দেখতে পাই না। কারণ সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি দখলদারত্বের ছোবলে নদী আজ দখল হয়ে গেছে। তাই, আমি বিআইডব্লিউটিএ-কে অনুরোধ করব, অতিসত্বর আপনারা লালকুঠি হতে রূপলাল হাউজ পর্যন্ত অংশে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল সরিয়ে ফেলুন। ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে টার্মিনালের এই অংশটি দ্রুত সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিন।”
ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও ফিরিয়ে আনতে এটাই সর্বোত্তম সময় উল্লেখ করে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “ঢাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দুঃখজনকভাবে দেখলাম, লালকুঠি আর ঢাকা গেইটই শুধু করপোরেশনের আওতাধীন। রূপলাল হাউজসহ যেসকল স্থাপনা ঢাকার অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছে, ঢাকাকে পরিচিতি দিয়েছে সেগুলো করপোরেশনের আওতাধীন নয়। তাই রূপলাল হাউজ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় হস্তান্তর করতে আজকের অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্টদের যে দাবি, সেই দাবির সাথে আমিও একাত্মতা পোষণ করছি। রূপলাল হাউজ আমাদেরকে হস্তান্তর করলে আমরা এর পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করব। আমরা ঢাকার সকল ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও স্মৃতিস্তম্ভের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চাই।”
অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডাইরেক্টর মারসি মিয়াঙ টেমবন বলেন, “লালকুঠি সংস্কারসহ ডিসিএনইউপি প্রকল্পের আওতায় গৃহিত কার্যাবলীর মাধ্যমে যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে এবং তার যে প্রদর্শনী আজ আয়োজন করা হয়েছে, তাতে আমি সত্যিকার অর্থেই আনন্দিত।”
এ সময় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডাইরেক্টর টেমবন ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত লালকুঠি এখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুনতাসীর মামুন বলেন, “রূপলাল হাউজ অবৈধ দখলের কবলে রয়েছে। আমি মেয়রকে বলবো –সেখানে দখলদার মুক্ত করুন। আপনারা যারা এখানে উপস্থিত আছেন, আমি বলবো, আপনারা মানে ঢাকাবাসী চাইলে রূপলাল হাউজকে দখলদার মুক্ত করা সম্ভব। আমি মেয়রকে অনুরোধ করব, সেখানে যে অবৈধ স্থাপনা হয়েছে তা ভেঙে ফেলুন। এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সিটি করপোরেশনের আওতায় নিয়ে আসুন। তাহলেই আমাদের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।”
এ সময় লালকুঠির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে দক্ষিণ সিটির গৃহিত উদ্যোগ প্রসঙ্গে মুনতাসির মামুন বলেন, “জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমি দেখলাম — এটা (লালকুঠি) পরিবর্তন হচ্ছে, আমার মনটা ভরে গেলো।”
ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের গুরুত্ব বর্ণনা করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, “কেউ চাইলেই ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায়, সাময়িকভাবে হয়তো লাভবানও হওয়া যায়। এতে ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা যায় না। কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আমার শহরে নিয়ে আসতে পারাটা যেমন মর্যাদার, তেমনি পর্যটক আকর্ষণের মাধ্যমে লাভবান হওয়াটা সম্মানেরও।”
হাতিরঝিল প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল উল্লেখ করে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের সভাপতি প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা বলেন, “সে সময় আমার বিরুদ্ধে ৭৮টি ইনজাঙ্কশন ছিল। আমরা ৩ মাসের মধ্যে সেসব ইনজাঙ্কশন খারিজ করে হাতিরঝিল প্রতিষ্ঠা করেছি। তাই আমি বিশ্বাস করি, লালকুঠির সংস্কার উদ্যোগের মাধ্যমে যে কাজ মেয়র শুরু করেছেন, তিনি এরপর একে একে ঐতিহ্যবাহী সকল স্থাপনা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ঢাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।”প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা এ সময় হাতিরঝিল প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ঢাকা-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর রিজিওনাল ডাইরেক্টর জন রুম (John Roome), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ফজলে রেজা সুমন, দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বক্তব্য রাখেন।
করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর সিতওয়াত নাঈম, প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ, করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামান, প্যানেল মেয়র ও ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শহিদ উল্লাহ, ৪২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম,
৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আরিফ হোসেন ছোটন, ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান (ইমন), অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হায়দার আলী, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন, ডিসিএনইউপি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম, অঞ্চল-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।