সাজেদ রহমান : মোল্লাহাটি বনগাঁ মহকুমার একটি গ্রাম। এই গ্রামে একটি বড় নীলকুঠি ছিল। সেই নীলকুঠির পটভূমিকায় বিভূতিবন্দোপাধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইছামতি’। দুইবার গেছি ওই গ্রামে আমি, বেড়াতে। বনঁগা থেকে চাকদাহ রোড ধরে ১০ কিলোমিটার যাবার পর একটি রাস্তা নেমে গেল উত্তরে। এক কিলোমিটার গেলেই বারাকপুর। বিভূতি বাবুর বাড়ি। বারাকপুরের উত্তর ধার দিয়ে ইছামতি ডান হাতে সমান্তরালে রেখে বাজিতপুর পর্যন্ত চলে গেছে যে রাস্তা সেই রাস্তা অধুনা গড়ে ওঠা শ্রীপল্লীর শেষ পর্যন্ত পিচের। এখন যেখানে শ্রীপল্লী, একদিন সেখানেই ছিল নীলকুঠিয়ালদের কুঠি, নীল চাষের মাঠ। শত শত কৃষকের রাঙা রক্ত মোক্ষণ করে নীলকর ইংরেজরা বার করত নীল। কুঠিয়াল সাহেবদের দিন ফুরাল। পড়ে থাকল মাঠ। খড়ের মাঠ নাম নিয়ে দেড়’শ বছর কাটল। এখন সেখানে জনবসতি। নতুন ভাবে গড়ে উঠেছে গ্রাম্য সমাজ। বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন লোক এসে গড়ে তুলেছে গ্রাম্য সমাজ নিজেদের মত করে। শ্রীপল্লীর পশ্চিমসীমায় শ্রীপল্লী বাজার। সেখানে কিছু দোকান। হাটও বসে এখন শ্রীপল্লীতে। এর পরেই খাল। গোপালনগর বাওড় থেকে এসে মিশেছে ইছামতি নদীতে। খালের ওপর ব্রিজ। সেই ইছামতি দুরে সরে গেছে। রেখে গেছে তার দুটি ধারা যাদের এখন বটতলার দোয়া এবং কলাতলার দোয়া বলা হয়। বাংলা ১৩০৭ সালে বন্যার পর ইছামতি এই চিহ্ন রেখে খাত পরিবর্তন করে উত্তরে সরে যায় আর শঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। তার ধার দিয়েই রাস্তা। তিন কিলোমিটারের মাথায় সুন্দরপুর। সেখান থেকে বাজিতপুরের পথ ছেড়ে ডান ধারে আর একটি রাস্তা গেছে। সে রাস্তার দু’পাশে বট অশ^থ গাছ পোঁতা হয়েছিল। আজও তার অস্তিত্ব বর্তমান। অনেক গুলো এখনও টিকে আছে। দিগন্ত বিস্তৃত আবাদী মাঠ অতিক্রম করে আরও প্রায় ৩ কিলোমিটার গেলেই তবে মোল্লাহাটি। প্রথমেই পথের বাঁ ধারে ননীগোপালের গম কল। তার পাশেই শিবতলা। একটি বৃহৎ অশ^থ গাছ। তার তলায় ইট গাঁথা ত্রিশুল পোতা। সেখানে হয় গাজন উৎসব ও মেলা চৈত্র সংক্রান্তিতে। ভাদ্র মাসে হয় মনসা পুজা আর সে উপলক্ষ্যে মেলা। এরপর সংকীর্ণ গ্রাম্য ভাগাড় পথ বলা চলে না। পথের বাঁ ধারে ছাড়া ছাড়া কয়েকটি কুঠির, সবাই আদিবাসী। কয়েকখান পাকা বাড়ি টালির চাল, ভাগাড়ের দু’পাশে দেখা যায়। একটু এগোলেই ডান হাতে সরকারি পাকা ডাকবাংলো। সামনে পিছনে বারান্দা। একটি বৃহৎ কক্ষ। পিছনের বারান্দায় একটি কামরা। খড়খড়ি লাগান দরজা জানালার অবস্থা এখনও ভালো আছে। সাত বিঘা জমির ওপর এই বাড়ি। একটি স্যানিটারি পায়খানা আছে। বঙ্গবঙ্গের দু’বছর আগে ব্রিটিশ আমলে এটি নির্মাণ করা হয়। এর পূর্বে ছিল খড়ের আটচালা ঘর। আগে এর তত্বাবধানকারী ছিল। তার মৃত্যুর পর আর কেউ দেখে না। সম্ভবত আগে এর গুরুত্ব ছিল। এখন কোন গুরুত্ব নেই। কিন্তু এই সরকারি বাড়ি অন্য ভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। একঘর বাস্তহারা এখানে বসবাস করছে। পথের বাঁ ধারে একখানা দোকান। দোকানদারের নাম নঙ্কু বাবু, আদিবাসী যুবক।
এরপর আরও সঙ্কীর্ণ উচু নিচু পথ। কোথাও ইটের ইস্তুপ। ভাঙ্গা ইটের টুকরা জঙ্গল অতিক্রম করে বিরাট স্তুপের কাছে গেলেই বোঝা যাবে এখানে একদিন বিশাল অট্টালিকা ছিল। তার ধারে দু’খানি খড়ের দো-চালা, দু’একটা আম কাঠালের গাছ দু’চার বছর পূর্বে পোতা হয়েছে। স্তুপের উপর উঠলেই দেখা যাবে দু’হাত উচুঁ প্রাচীর বেষ্টিত চাতাল। সেখানে নীল পচানো হতো। এটাকে নীল চোবাচ্চ বলা হয়। এর এক ধারে প্রাচীর ভেঙ্গে গেছে। চালাঘর দু’টি গোবিন্দ সাধুর আস্তানা। বছর কুড়ি তিনি এখানে আস্তানা গেড়েছেন। এই ঢিবির দক্ষিণ দিকের ঢালু অংশে আছেন আর এক বৈরাগী ও বৈরাগিণী আস্তানা গেড়ে। একখানা তিন চালা খড়ের ঘর। বৈরাগীর নাম গুরুপদ। তার বাড়ি ছিল পাঁচপোতায়। এর জমিজমা আছে। এই কুঠি সংলগ্ন বিঘা চারেক আবাদ করেন পাট ডাল ইত্যাদি। এই নীল কুঠিই একদিন ছিল ১৫২ কুঠির প্রধান কার্যালয়। এই কুঠির এলাকা ছিল উত্তর উত্তর পূর্বে ইছামতি নদী, পশ্চিমে বামনডাঙ্গা এবং দক্ষিণে খাবরাপোতা। এই বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়েই ছিল নীলের আবাদ ও তার কারখানা, কার্যালয় আর নীলকর সাহেবদের নীলকুঠি। এখন সবই ধ্বংসস্তুপ, ইট, কাঠ যে যা পেরেছে নিয়ে গেছে। এখনও নিচ্ছে। একদিন হয়তো এর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। নীলকর সাহেবদের অফিস ঘর এখানে ছিল।
বিচারে যেসব হতভাগ্য কৃষকরা শাস্তিভোগ করতেন তাদের আটক রাখা হতে ফাটক ঘরে। আর যাদের প্রাণদন্ড দেয়া হতো, তাদের ফাঁসি দেয়া হতো আরামডাঙ্গার বটগাছে ফাঁসি লটকে। এই স্তুপের পশ্চিম পাশে বিরাট পুকুর ছিল। তার ছিল বাঁধানো ঘাট। এখন সেটা ডোবা। পাশে ছিল বিরাট আম বাগান, এখন নেই। এখন সেখানে কৃষি ক্ষেত। সেই আম বাগানের মধ্যেই রয়েছে আর টি গায়া মেমের সমাধি। কয়েক বছর আগে সেখানে খোড়া হয়েছিল। বাউল সর্দার এখন ওই জমির মালিক। কবর খুড়ে নাকি পাওয়া গিয়েছিল সীসা। এখানকার উত্তরে, পুকুরের উত্তরে ছিল লারমোর সাহেবের সমাধি। সমাধি অপসৃত। এই কুঠির আর এক ইংরেজ ছিল মালিক, তার নাম জেমস ফরলং। জমির মালিক এখন দুলাল সর্দার। এখন সবই আবাদী জমি। পাট, মসুরি ফলছে। ইছামতি এখান থেকে সরে গেছে। তার নাম হয়েছে পাঁচপোতার বাওড়। তার উত্তর দিয়ে বসে গেছে ক্ষীন ইছামতি। নীল কুঠিতে জল সরবরাহের জন্য গরুর সাহায্যে পানি তোলা হত। তার চিহ্নও বর্তমান। এখনকার লোক বলে চিনি কল।
মোল্লাহাটির কুঠির এখন আর কোন আকৃতি এখন নেই। আছে ভগ্নস্তুপ আর ইটের ছড়ানো টুকরা। আর যেসব মজুর এনেছিল নীলকর সাহেবরা সাওতাল পরগনা থেকে কুঠিতে কাজ করার জন্য, তারা এখন অনেকে এখন জমির মালিক। কিন্তু তারা চাষাবাদ বুঝতে না পারার কারণে অনেক জমি তাদের বেহাত হয়ে গেছে। তবে এখনও প্রায় ৭৫ ঘর সাঁওতাল বাস করেন মোল্লাহাটিতে। তাদের মধ্যে জমিজমা আছে কিছু লোকের। নিতেন সর্দার, কেষ্ট সর্দার, কেতু সর্দার, বাউল সর্দার, আর ননী সর্দার। ননী সর্দারের প্রায় ৩ বিঘা জমি আছে। এদের অবস্থা কিছুটা স্বচ্ছল। ইটের দেয়াল, টালির চাল দেয়া একাধিক ঘর আছে। বাকী সকলেই ক্ষেত মজুর। এখন সর্দার পাড়া দুটি, পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়া। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, তাতে সর্দারদের ছেলেমেয়েরা পড়ে নগন্য।