বিশেষ প্রতিবেদক : নানা ঘটনা প্রবাহে মহাকালের গর্ভে যেতে বসেছে আরও একটি বছর। বিদায় নিচ্ছে ২০১৯। নানা ঘটন-অঘটন নিয়েই বছর জুড়ে চলেছে দিনযাপন। বছর জুড়ে প্রশাসনের ঝুলিতে ভালো কাজ যেমন ছিল, তেমনি ছিল সমালোচনা। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষমতাহরণ ও নারী কেলেঙ্কারিসহ কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনাও বছরজুড়ে প্রশাসনকে নাড়া দেয়।
বহুল প্রতীক্ষিত সরকারি কর্মচারী আইন এ বছর থেকে কার্যকর হয়েছে। চলতি বছর দুই দফা বড় ধরনের পদোন্নতিও দেয়া হয় প্রশাসনে। শেখ হাসিনা সরকারের চতুর্থ মন্ত্রিসভা গঠনের পর এ বছরই দু’দফা পুনর্বিন্যাসও করা হয়।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকার এ বছর শুদ্ধি অভিযান শুরু করলেও প্রশাসনে সেভাবে তা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। যেমনটি ছিল তেমনটি না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কারণে অস্বস্তিতে পড়তে হয়ছে প্রশাসনকে।
চতুর্থ নতুন মন্ত্রিসভা গঠন ও দু’দফা পুনর্বিন্যাস : গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী নিয়ে গঠন করা হয় নতুন মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে রাখা হয় ছয় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিসভা গঠনের প্রায় সাড়ে ৪ মাসের মাথায় ১৯ মে তা পুনর্বিন্যাস করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে একই মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী করা হয়। আগে তিনি এ মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু পুনর্বিন্যাস করায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওপর মোস্তাফা জব্বার নিয়ন্ত্রণ হারান।
এছাড়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী করা হয় তাজুল ইসলামকে। তাজুল ইসলাম আগে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং স্বপন ভট্টাচার্যকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একই মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান স্বপন ভট্টাচার্য। এখানে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব হারান তাজুল ইসলাম।
পরে ১৩ জুলাই মন্ত্রী হিসেবে ইমরান আহমদকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি আগে এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ওইদিন ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাকে দেয়া হয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
দু’দফা বড় পদোন্নতি : নতুন সরকার গঠনের পর এ বছরের ১৬ জুন প্রথমবারের মতো বড় ধরনের পদোন্নতি হয় প্রশাসনে। ওইদিন জনপ্রশাসনে ১৩৬ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনে এটাই প্রথম বড় ধরনের পদোন্নতি। যুগ্ম সচিবের পর গত ২৩ অক্টোবর প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। ওইদিন ১৫৬ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে আদেশ জারি করা হয়।
২০১৯ সালে প্রশাসনে মোট ৩৪ জন কর্মকর্তাকে সচিব করা হয়। ২১ জানুয়ারি একজন, ২৬ ফেব্রুয়ারি দুজন, ২৬ মে ১১ জন, ২১ জুলাই পাঁচজন, ২৪ জুলাই একজন, ১ আগস্ট নয় জন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
এছাড়া ২২ অক্টোবর দুজন, ৫ নভেম্বর একজন, ৫ ডিসেম্বর একজন এবং ১৮ ডিসেম্বর একজন সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান।
চলতি বছর ২২ কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। এর মধ্যে ৩১ জানুয়ারি পাঁচজন, ১২ ফেব্রুয়ারি একজন, ২৭ ফেব্রুয়ারি একজন, ৪ এপ্রিল দুজন, ১৪ জুলাই একজন, ২৯ আগস্ট একজন এবং ১৬ সেপ্টেম্বর আটজনকে সিনিয়র সচিব করা হয়। সর্বশেষ ২৩ ডিসেম্বর আরও সাত সচিবকে সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
যেসব কর্মকর্তাদের কর্মফলে সুনাম হারায় প্রশাসন : এ বছর এক বাংলাদেশি দূতাবাস কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভারতীয় এক তরুণীকে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ সামনে উঠে আসে। ভারতের আসামে গুয়াহাটির বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার কাজী মুনতাসীর মুর্শেদ দূতাবাসে ডেকে নিয়ে ওই তরুণীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠে।
দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলীর কাছে গত বছরের ২৫ মার্চ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন আসামের গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই তরুণী। অভিযোগপত্রের সাথে অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার কাজী মুনতাসীর মুর্শেদের সঙ্গে তার বিভিন্ন সময় হওয়া চ্যাটের স্ক্রিনশটও পাঠান অভিযোগকারী ওই তরুণী। অভিযোগের একটি অনুলিপি তিনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠায়। সময় সংবাদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে আরো নানা তথ্য উপাত্ত।
অনিয়ম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে : বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেন দিন দিন অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বজনপ্রীতির আখড়া হয়ে উঠছে। এ বছর সময় সংবাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নারী নিপীড়নের তথ্য।
ভিয়েতনামের হ্যানয় দূতাবাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের বিরুদ্ধে অধস্তনদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। জানা যায়, বিভিন্ন সময় দূতাবাস কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে আসছেন তিনি।
মন্ত্রণালয় সূত্রে সময় সংবাদের কাছে অভিযোগ আসে, সামিনা নাজ কথায় কথায় লিখিতভাবে বরখাস্ত করেন অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। অনেক সময় তাদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতনও চালান তিনি। তার নির্যাতন এত ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে কোনো কর্মকর্তাই এই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কাজ করতে রাজী হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ম মেনে কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেয়া হয় না। পোস্টিং বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সুবিধাভোগী কিছু কর্মকর্তা প্রতিবারই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নিউইয়র্ক, জেনেভা বা লন্ডনের মতো আকর্ষণীয় জায়গায় পদায়ন পাচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম জানায়, যারা স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই ভালো জায়গায় পদায়ন পেয়েছেন। যেমন, সাদিয়া ফয়জুন্নেসা নিউইয়র্ক থেকে এসেই আবারো নিউইয়র্কে পদায়ন পেয়েছেন, ফাইয়াজ মুন্সী কাজী নিউইয়র্ক থেকে এসে পোস্টিং পেয়েছেন জেনেভাতে, শাহানারা মনিকা ওয়াশিংটন থেকে এসেই পোস্টিং পেয়েছেন নিউইয়র্কে, দেওয়ান মাহমুদ অটোয়াতে আট বছর থেকে এসে মাত্র আট মাসের মাথায় পদায়ন পেয়েছেন লন্ডনে।
সূত্র বলছে, এমন অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা চার-পাঁচ বছর ধরে মন্ত্রণালয়ে পরে থেকেও কোথাও পোস্টিং পান নি। অথচ স্বল্প সংখ্যক কিছু কর্মকর্তা ঠিকই সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন কোনো না কোনো ক্ষমতার উৎসকে কাজে লাগিয়ে।
সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের নারী কেলেঙ্কারি : আগস্ট মাসের শেষের দিকে জামালপুরের তখনকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীরের একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে ডিসি আহমেদ কবীরের সঙ্গে তার অফিসের এক নারীকর্মীকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়। এতে তুমুল সমালোচনার মুখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে প্রশাসন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ২৫ আগস্ট আহমেদ কবীরকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওইদিনই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা) মুশফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ২২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। ২৫ সেপ্টেম্বর আহমেদ কবীরকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ইউএনওর কেলেঙ্কারি : ডিসি আহমেদ কবীরের আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ ইমতিয়াজের নারী কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসে। বছরের মাঝামাঝি সুনামগঞ্জের হাওর উপজেলা তাহিরপুরে যোগদান করা বিতর্কিত ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজকে নিয়ে বিব্রত হয় প্রশাসন।
চট্টগ্রামে কাজ করার সময় জেলা প্রশাসকের কাছে আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে বিচার চান তার বান্ধবী দাবি করা এক তরুণী। পরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে উপজেলা ইউএনও হিসেবে তাকে বদলি করা হয়। বদলির পরই তার জীবনের কলঙ্কিত ঘটনাটি আরও ব্যাপকভাবে প্রচার পায়।
জানা যায়, ওই তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন আসিফ ইমতিয়াজ। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন আসিফ। এরপর ওই তরুণী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে বিচার চান। এরপরই তাকে চট্টগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বদলি করা হয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর তাকে ইউএনও পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়।
দিনাজপুরের ডিসি: গত অক্টোবর মাসে এক নারীর সঙ্গে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাহমুদুল আলমের অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ উঠে। ওই সময় এক ভিডিও বার্তায় ডিসির সঙ্গে নিজের অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য ফাঁস করেন এক নারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় ভিডিওটি।
কার্যকর সরকারি চাকরি আইন: অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ গত ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর সরকারি চাকরি আইনের গেজেট জারি হয়। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইতোপূর্বে কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি। সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজন মতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত দুটি সরকারের সময় আইনটি করার জন্য কয়েক দফা খসড়া প্রণয়ন করা হলেও খসড়ার বিভিন্ন বিধান নিয়ে বিতর্ক ওঠায় কয়েক দফায় উদ্যোগ ভেস্তে যায়। যদিও আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি রয়েছে।
ইউএনও হোসনে আরা বেগম বীনার আবেগঘন স্ট্যাটাস: নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বেগম বীনা সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। আলোচনার কেন্দ্রতে ছিল তার সন্তান সম্ভাবা হওয়ার বিষয়টি। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার কোল জুড়ে আসে প্রথম সন্তান। তবে সন্তান অপরিপক্ক জন্ম নেয়ায় স্কয়ার হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয় তাকে।
দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের পর মা হয়ে সৌভাগ্যবতী হলেও সাধনালব্ধ সন্তানের এমন শারীরিক অবস্থা দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই ইউএনও। তার নিষ্পাপ সন্তানের এমন অবস্থার জন্য একজনকে দায়ী করে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বীনা তার ফেসবুকে একটি আবেগ মাখানো স্ট্যাটাস দেন।
তার ওই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-‘আমি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত ফেসবুকে খুব একটা শেয়ার করি না। তবে আজ মনে হলো এখন চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। তাই আজ আর না, আজ আমি বলবো… আমি হোসনে আরা বেগম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণগঞ্জ সদর, মাত্র ৯ মাস পূর্বে আমি এ পদে যোগদান করি।
আমার দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চেষ্টা চিকিৎসার পরও আমরা কোনো সন্তান লাভ করতে পারিনি। কিন্তু পাঁচ মাস পূর্বে আমি জানতে পারি আমি দুই মাসের সন্তানসম্ভবা। এ ঘটনা আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া আর কিছুই নয়, এ বিশ্বাস আমি প্রতিনিয়ত বুকে ধারণ করেছি। এ বিশ্বাস ও স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম।
উল্লেখ্য আমি আমার বাবুকে পেটে নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ-৪ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের আংশিক নির্বাচন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি।
একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে অজুহাত, ফাঁকিবাজী এই বিষয়গুলোকে কখনই পুঁজি করিনি।
অথচ আমি সন্তান সম্ভবা হয়েছি শোনার পর থেকেই একজন বিশেষ কর্মকর্তা, যার নাম বলতেও আমার রুচি হচ্ছে না, বিভিন্ন মহলে আমাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলীর পাঁয়তারা করেই চলেছিল।
আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রেগুলার চেকআপ করতে আমি হাসব্যান্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি।
চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমরা হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য, এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায় আমার সদাশয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে।
আমার অপরাধ হলো আমি সন্তানসম্ভবা। আর তার চেয়েও বড় কারণ হলো সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার উপরের মহল কর্তৃক তদবির।
খবরটা শোনার পর আমি প্রচ- মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি। আমি অ্যাজমার রোগী। প্রচ- মানসিকচাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।
তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রি-ম্যাচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিওতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কী অপরাধ ছিল? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল আমি জানি না! তবে জানি একজন সব দেখেন তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের ওপর এই জুলুমের বিচার করবেন। এ ঘটনার পর বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
ওসি মোয়াজ্জেমের রায়: ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের আপত্তিকর ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার মামলায় ২৮ নভেম্বর ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে আট বছরের কারাদ- দেন আদালত। গত ১৭ জুলাই সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সেদিন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আদালতের কাছে দাবি করেন, তিনি নির্দোষ।
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে গত ১৫ এপ্রিল মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়। সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গত ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। আদালত তা আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেন। ১৬ জুন হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।
নুসরাত জাহানকে গত ৬ এপ্রিল পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেন তার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ১০ এপ্রিল সে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এর ১০ দিন আগে নুসরাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে সোনাগাজী থানায় যান। থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন এবং তা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ আনা হয় মামলায়। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় গত ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ আসামিকে মৃত্যুদন্ড দেন।