শৃঙ্খলা ফেরাতে নেই কোনো তৎপরতা
মহসীন আহমেদ স্বপন : করোনা সংক্রমণ রোধে জনমাগম বন্ধ করতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের নির্দেশে দেশে কার্যত লকডাউন চলছে। এই সময়ে সবাইকে যখন নিজ দায়িত্বে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরে থাকার পরামর্শ আসছে, ঠিক তখনই রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় জনসমাগম বেড়েই চলেছে। নিষেধাজ্ঞার দুদিন না যেতেই ঘর ছেড়ে রাস্তায় বের হয়েছে মানুষ।
সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, মহাখালী, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, গোপীবাগ রেলওয়ে বস্তিসহ বেশিকিছু জায়গায় অস্বাভাবিক জনসমাগম দেখা গেছে। বিশ্বজুড়ে করোনা কালোছায়া যখন ঘনীভূত হয়ে আসছে, তখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী কানেই তুলছেন না এসব এলাকার বাসীন্দারা।
অবশ্য ঘর থেকে এই বাইরে বেরুনোর কারণ ‘বিশেষ প্রয়োজন’। কেউ বের হচ্ছেন খাবার কিনতে, কেউবা বাজারে যাচ্ছেন। এদিন সীমিত পরিসরে কয়েকটি খাবারের দোকানও খোলা রাখতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি জানিয়েছে, এই মুহূর্তে সক্ষমতা অনুযায়ী সীমিতভাবে রেস্তোরাঁ খোলা রাখার কথা ভাবছে তারা।
শনিবার ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ১০টি নির্দেশনা পাঠান। এতে বলা হয়, অনেক মানুষের রান্না-বান্নার ব্যবস্থা নেই, তাই তাদের জন্য খাবার হোটেল, বেকারি খোলা থাকবে। এসব হোটেল-বেকারিতে কর্মরতদের সড়কে চলাচল করতে দিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য পণ্যের দোকান খোলা থাকবে এবং এসব দোকানে কর্মরতরা কাজে যোগ দিতে পারবেন। হোটেল থেকে গ্রাহকদের খাবারের পার্সেল নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে’ কেউ হোটেলে বসে খেতে পারবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঢাকায় যেকোনও নাগরিক একা যেকোনও মাধ্যম ব্যবহার করে চলাফেরা করতে পারবেন বলেও নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
ডিএমপি থেকে এই সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসার পর রবিবার রাজধানীর রাস্তাঘাটে বেশি মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। রাস্তায় উল্লেখযোগ্য হারে রিকশাও চলছে।
মিরপুর রোডে এক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আজ অনেক মানুষই বের হচ্ছেন। এই কয়দিন নারীদের চলাফেরা না থাকলেও আজ অনেকেই বেরিয়েছেন বাজার করতে। শিথিলতার ঘোষণা আসার পর কিছু দোকানও খুলেছে। সরেজমিনে ধানমন্ডির ৬ নম্বরে একটি ফাস্টফুডের দোকান খোলা দেখা যায়। দোকানটির ভেতর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য মেঝেতে দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে।
ধানমন্ডির বাসিন্দা রোকসানা জানান, এই তিন দিন ঘর থেকে বের না হলেও সোমবার তিনি বেরিয়েছেন। বাসার জন্য খাবার কেনার জন্য প্রধান সড়কের একটি কনফেকশনারিতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, বাজারে তো আর সব কিছু পাওয়া যায় না। কিছু কিছু জিনিস যেমন ফ্রোজেন আইটেমগুলো নিতে কনফেকশনারিতে আসা।
ফার্মগেটে টিসিবি’র পণ্যবাহী গাড়িগুলো অবশ্য সামাজিক দূরত্ব মেনেই সেখানে দেওয়া হচ্ছে পণ্য। রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়ানোর জন্য দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের মাস্ক বিতরণ করতেও দেখা যায়।
ডিএমপি থেকে নির্দেশনা আসার পর রেস্তোরাঁ সীমিত আকারে খোলা রাখার কথা ভাবছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা সমিতির অফিসে বৈঠকে বসেছি। রেস্তোরাঁ খোলা রাখতে আমরা একমত। কিন্তু আমাদের স্টাফরা তো গ্রামে চলে গেছে। তারপরও আমরা দেখছি কীভাবে খোলা রাখা যায়।’
তিনি বলেন, ‘যারা যারা পারবেন তারা সীমিত আকারে খুলবেন। পাশাপাশি আমরা সামাজিক দূরত্ব মেনেই রোস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়েও ভাবছি।’
মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে কাঁচাবাজার এলাকায় নি¤œ আয়ের শতাধিক মানুষ খাবার নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য বিধি না মেনে লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে। এ নিয়ে সোমবার দৈনিক সকালের সময় এ ‘বেশীরভাগই মানছে না হোম কোয়ারেন্টাইন, ভয়াবহ রূপ নিতে পারে করোনা’ শিরোনামে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। তারপরও মানুষ রাস্তায় নামছে জীবন জীবিকার উদ্দেশ্যে।
মুগদার মদিনাবাগ বাজারের এক কোণে সবজি বেচেন ওয়াসিম। এতো ভিড়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের ভয় করেন না- এমন প্রশ্নে এই বিক্রেতা বলেন, স্যার বেচা বিক্রি না করলে খামু কি? ভয়তো করে। কিন্তু দোকানতো বন্ধ করতে পারি না। ডেইলি ইনকাম দিয়া সংসার চলে, ঘর ভাড়া দেই, তাই আসন লাগে। অন্য কোনো কামওতো নাই যেইহানে ভিড় নাই।
মুগদার বাসার টাওয়ার সংলগ্ন মদিনাবাগ বাজারের মতো একই অবস্থা মানিকনগর, খিঁলগাও গোপীবাগের। এসব বাজারে সকাল বিকাল দুই বেলায় ক্রেতার উপচেপড়া ভিড় থাকে। অথচ প্রতিটি বাজারের পাশেই কোনো না কোনো থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন প্রশাসনের তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সচেতন মানুষ।
আলী আহাসন নামের এক সাবেক শিক্ষক বলেন, করোনায় রীতিমতো চমকে যাচ্ছি, সাড়ে সাতলাখ মানুষ আক্রান্ত চৌত্রিশ হাজার মানুষ মারা গেছে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশে করোনা প্রকট হয়ে উঠলো অন্তত ঢাকাকে রক্ষা করা যাবে না। এমন বিপদেও মুগদা এলাকার মানুষ রাস্তায় ঘোরফেরা করছে, এরা নিজেরা বিপদে যতটা না পড়বে তারচে বেশি বিপদে ফেলবে আমাদেও, মানুষের অবাদ বিচরণে করোনার সামাজিক সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
করোনার ভয়াবহতায় মুগদা-মান্ডাসহ আওতাধীন এলাকা মুগদা থানার অফিসার ইনচার্জ প্রলয় কুমার রায়কে এসব এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এই এলাকগুলো খুব ঘনবসতিপূর্ণ। তারপরও আমরা চব্বিশ ঘণ্টা টহল পুলিশ দিয়ে উিউটি করাচ্ছি জনসমাগম কমাতে।
তিনি বলেন, খালি রাস্তা বা ছোট খাটো ইনসিডেন্টেও এসব এলাকায় চার পাঁচ শ লোক জড়ো হয়ে যায়। আমরা রাস্তা থেকে লোক সড়িয়ে ঘাড় ঘুরাতে ঘুরাতে দেখি আবারও রাস্তা ভড়ে গেছে। বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ থাকে এসব এলাকায়। তাই সচেতনতা নেই। এরা এর ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারছে না। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। লোকাল কাউন্সিলরদের নিয়ে কাজ করছি।
বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষাণা হওয়া করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) এখন পর্যন্ত ৭ লাখ ২২ হাজার ১৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষের। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে নতুন করে আরও একজনসহ মোট ৪৯ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। সুস্থ হয়েছেন ১৯জন।