স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ
এম এ স্বপন : সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। নাগরিকদের ঘরে থাকতে আহ্বান করা হচ্ছে। তারপরও রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার প্রতিদিন লোকে লোকারণ্য থাকছে।
এসব বাজারে কেউ বাজার করতে, আবার কেউ কেউ অকারণেই এসে ভিড় করছেন। একসঙ্গে জড়ো হয়ে কেউ কেউ খোশগল্পও করছেন। আর যারা বাজার করছেন তাদেরও মধ্যেও কোনো ধরনের সচেতনতা নেই।
একসঙ্গে একাধিক ক্রেতা ঘিরে ধরে রাখছেন বিক্রেতাকে। এমনকি একজনের ঘাড়ের ওপর দিয়ে আরেকজন বিক্রিতার সঙ্গে কথাও বলছেন। প্রায় একজন ক্রেতার সঙ্গে আরেকজন ক্রেতার শরীরে স্পর্শ হচ্ছে।
অথচ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকে। অর্থাৎ একজন অন্যজনকে স্পর্শ না করা। কিন্তু বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ধার ধারছে না কেউ।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আমরা লক্ষ্য করেছি, লোকজন এখনও ঘোরাফেরা করছে। অলিগলিতে বেশি করে ঘোরাফেরা করছে। সকালের বাজারে আমরা দেখি লোকজনের উপস্থিতি অনেক বেশি হচ্ছে। তাতে আমরা মনে করি, সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে যাবে। শনিবার করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি অনলাইন ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৫৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাস বেশ কয়েকটি জায়গায় বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর ও বাসাবো। অন্যান্য জেলাতেও করোনা ছড়িয়ে গেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে অন্যান্য জেলায় বেশকিছু লোক ছড়িয়ে গেছে এবং সেখানে আক্রান্ত করেছে। এই বিষয়টি উদ্বেগজনক। এই বিষয়টি আমাদের আরও কঠিনভাবে দেখতে হবে এবং এটা বন্ধ করতে হবে।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘আপনাদেরকে বুঝতে হবে, প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন, সেগুলো আমাদেরকে মেনে চলতে হবে। আপনারা ইউরোপ, আমেরিকার দিকে তাকান। কী ভয়াবহ চিত্র সেখানে বিরাজ করছে। আমরা জানি, লকডাউন যদি ভালোভাবে কার্যকর হয়, তাহলে সংক্রমণ কমবে। ইউরোপ, আমেরিকাতে প্রায় এক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেছে, প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ লোক আক্রান্ত হয়ে গেছে। আমাদের এখানে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বা বন্ধ করা হয়েছে। আশা করব, এই কয়েকটি দিন কষ্ট করে যেন বাড়িতে থাকি। এখন কষ্ট করলে এই করোনার বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারব আমরা।’
এ সময় সবাইকে ঘরে থাকার ও বেশি বেশি করোনাভাইরাস পরীক্ষা করারও পরামর্শ দেন জাহিদ মালেক।
শনিবার সকালে রামপুরার মোল্লাবাড়ি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দলে দলে মানুষ। বাজারটিতে মানুষের ভিড় এতটাই দেখা যায় যে, চলাচলের জন্য একজনকে অন্যজনের প্রায় শরীর ঘেঁসে চলতে হচ্ছে। যারা বাজার করছেন তারাও দোকানের সামনে গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকছেন। যেন করোনাভাইরাস নিয়ে কারও মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
বাজারটি থেকে সবজি কেনা মধ্যবয়সী এক নারীকে দেখা যায়, একজন ক্রেতার পেছন দিক থেকে গিয়ে তার গাঁ ঘেঁষে বিক্রেতার কাছে সবজির দাম জানতে চাচ্ছেন।
এরপর ওই নারীর সঙ্গে এ প্রতিবেদক কথা বললে নিজেকে ফাতেমা বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে এভাবে না দাঁড়িয়ে উপায় কী? বিক্রেতার কাছে না যাওয়া পর্যন্ত তো কেউ দাম বলবে না, কোনো কিছু কেনাও যাবে না।’
এভাবে ভিড় করলে করোনা হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ কথা বলতেই তিনি বলেন, ‘যার করোনা হবে তার ঘরের ভেতরে থাকলেও হবে। করোনার ভয়ে তো আর না খেয়ে থাকতে পারি না।’
বাজারটির সবজি বিক্রেতা মশিউর বলেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই। যতই বলি কেউ কথা শোনে না। সবাই একসঙ্গে এসে দোকানে ভিড় করে। এক সপ্তাহ ধরে বাজারে মানুষের ভিড় যেন আরও বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আগে বাজারের কোনো সময়সীমা ছিল না। কিন্তু এখন দুপুর ২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। ২টার পর দোকান খোলা রাখা যাবে না। এ কারণেই হয়তো ক্রেতাদের ভিড় বেশি হচ্ছে। সবাই ২টার আগে বাজার করার জন্য ছুটে আসছে।’
রামপুরা থেকে মালিবাগ হাজীপাড়া বৌ-বাজারে গিয়েও ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। এ বাজারটিতে প্রতিদিন শতশত মানুষ একসঙ্গে জড়ো হচ্ছেন। সামাজিক দূরুত্ব বাজার রাখার ক্ষেত্রে সেখানো কারও কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি যারা জড়ো হচ্ছেন তাদের মধ্যেও কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি।
বাজারটির এক ব্যবসায়ী মিলন। তিনি বললেন, ‘এখানে মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। কয়দিন আগেও পুলিশ এসে লাঠি দিয়ে সবাইকে দাবড় দিয়ে গেছে। কিন্তু এখন আবার আগের অবস্থা। সবাই একসঙ্গে বাজারে এসে ভিড় করছে। এতে আমাদেরও ঝুঁকি বাড়ছে। কিন্তু কিছু করার নেই।’
তিনি বলেন, ‘পরিবারের খরচ চালাতে গেলে দোকান খুলতেই হবে। এই দোকানের ওপরই আমার চার সদস্যের পরিবার চলে। দোকান বন্ধ রাখলে না খেয়ে থাকতে হবে।’
বাজারটি থেকে সবজি কিনতে আসা আয়নাল নামের একজন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ভয়ে বাসা থেকে খুব একটা বের হই না। বাসায় বাজার না থাকায় বাজার করতে এসেছি। বাজারে এসে দেখি মানুষের অনেক ভিড়। নিজে সেভে চলার চেষ্টা করলে অন্য কেউ এসে ঘাড়ের ওপর পড়ছে। এটা খুব বিরক্তিকর।‘
তিনি বলেন, ‘সরকার মানুষকে সচেতন করার সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষ যাতে ঘরে থাকে এজন্য সাধারণ ছুটির সময় একের পর এক বাড়ানো হচ্ছে। এখন সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়া বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসছে না। নিজেরা সচেতন না হলে লাভ হবে না।’