বিশেষ প্রতিনিধি (সিলেট) : তিন দফা স্থগিতের পর কৌশল পাল্টে এবার ঢাকায় নিলাম হতে হয়েছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্ত নদী জাদুকাটার লুট হওয়া ১১০ কোটি টাকার বালি পাথর। মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) সভা কক্ষে অতি গোপনে এ নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কিন্তু মঙ্গলবারের নিলাম সম্পন্নের তথ্য জানালেও নিলাম ডাকে কতজন অংশ নেন,সর্ব্বোচ্য দরদাতা হিসাবে কত টাকায়? কে নিলাম ডাক পেয়েছেন? সেসব তথ্য মঙ্গলবার সন্ধা অবধি জানাতে পারেননি তাহিরপুরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও সহকারি কমিশনার (ভুমি)।
জানতে চাইলে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মেহেদী হাসান মানিক জানান, সহকারী কমিশনার ভুমি নিলাম সংক্রান্ত অনলাইন প্লাটফর্মে বিএমডির সাথে যুক্ত ছিলেন।
তাহিরপুরের উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি)মো. শাহরুখ আলম শান্তনু জানান, আমি নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বিএমডির নিলাম ডাকে যুক্ত হই, নিলাম ডাক শেষ হয়েছে তবে বিস্তারিত বিএমডির লোকজন বলতে পারবেন।

মঙ্গলবার নিলাম আহ্বানকারি খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) সহকারী পরিচালক আজিজুল ইসলামের নিকট নিলাম সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হয়। এরপর হোয়াটস আপে ম্যাসেস পাঠানো হয়।

সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় বিএমডির ওই পাতানো নিলামের আড়ালে এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা যুক্তরাজ্যে পলাতক সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য রণজিত চন্দ্র সরকারের ঘনিষ্ঠ সহচর আওয়ামী লীগ নেতা মোতালেব ওরফে ‘পাথ্থর মোতালেব’। তাহিরপুরের জাদুকাটা নদী তীরবর্তী ছড়ার পাড় গ্রামের মৃত মহর আলীর ছেলে তিনি।
উচ্চ আদালত ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) কিছু কর্মকর্তা, জেলা, উপজেলা, পুলিশের কিছু অসত অফিসার এ দুর্নীতির মহোৎসবে জড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিন তাহিরপুরের জাদুকাটা নদী তীরবর্তী লাউরগড় বাজারের উত্তরপাড়া,দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া, লাউড়গড়- সুনামগঞ্জ সীমান্ত সড়কের বানরাকোনা হাওর,পার্শ্ববর্তী ঢালার পাড়, ছড়ার পাড়, জাঙ্গালহাটি সহ একাধিক গ্রামের বসত বাড়ির ভেতর বাহির, লাউরগড় উচ্চ বিদ্যালয়ের আশে পাশে, সড়কের পাশে, ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের ভেতর খনিজ বালি,পাথর, সিঙ্গেল, বোল্ডার, নুরি পাথর সারি সারি স্তুপ করে রাখতে দেখা গেছে। ডাম্পিং করে রাখা এসব খনিজ বালি, পাথরের একাধিক ছবি ও ভিডিও ফুটেজ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৪৩১ বাংলা সনের জাদুকাটা নদীর বালিমহাল-১, ২ ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ওই বালিমহাল দুটির ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। গেল কয়েক বছর জাদুকাটা নদীতে পৃথকভাবে খনিজ পাথর মহাল ইজারা দেওয়া হয়নি। আর এ সুযোগ কাজে লাগান আওয়ামী লীগ নেতা পাথ্থর মোতালেব।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এক সময় টং-দোকানে পান বিক্রি করে সংসার চালাতেন মোতালেব। পরে বালি-পাথরের অবৈধ বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে এখন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার মালিক।
কথিত পাথর সমিতির সভাপতি মোতালেব স্থানীয় বালি-পাথর কারবারিদের ব্যবহার করে জাদুকাটা নদীর উৎসমুখ ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে পাথর (বোল্ডার) আনতে থাকেন।
একই সঙ্গে জাদুকাটা বালি মহাল-১, ২ ইজারার মেয়াদ শেষে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (প্রত্যাহারের পর পুলিশ হেডকোয়ার্টারে রিপোটকৃত) আ,ফ.ম আনোয়ার হোসেন খান, থানার বর্তমান ওসি দেলোয়ার হোসেন, গুসকান্ডে প্রশাসনিক কারনে বদলিকৃত থানার বাদাঘাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই আবুল কালাম চৌধুরী, এএসআই (বর্তমানে পদাবনতির পর কনষ্টেবল) আব্দুল জব্বার, উপজেলা, জেলা প্রশাসনের কিছু অসত কর্মকর্তার মদদে ড্রেজার, বোমা, সেইভ মেশিনে জাদুকাটায় অবৈধ কোয়ারি খনন করে নদীর তীর গ্রামের আশে পাশে সরকারি খাঁস ভ’মি থেকে, ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে প্রায় ১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি পাথর সিঙ্গেল বোল্ডার উক্তোলন করে মজুদ করা হয়।
স্থানীয়দের ক্ষোভের মুখে পড়ে মোতালেবচক্র ৩ আগস্ট ১০ হাজার ৭৪৩ ঘনফুট পাথর জব্দ দেখিয়ে বিএমডির উপপরিচালক (বদলিকৃত) মো. মামুনুর রশীদকে দিয়ে নিলামের আয়োজন করান। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের হলরুমে গেল ৭ আগষ্ট তুতীয় দফায় ওই নিলামের আয়োজনের পর সমালোচনার মুখে ওইদিনের নিলাম স্থগিত হয়।
তবে (১৬ সেপ্টেম্বর) মঙ্গলবার ঢাকায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর সভাকক্ষে সেই নিলাম সম্পন্ন হয় অতিগোপনে। নিলাম অনলাইন প্লাটফর্মে (জুমে) অংশগ্রহকারীরা নিলাম ডাকে অংশ নেন। গেল ৯ সেপ্টেম্বর অতি গোপনে চতুর্থ বারের মত উন্মুক্ত নিলাম আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএমডি।
মোতালেবের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে জাদুকাটা বোল্ডার পাথর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি দাবি করে চাঁদা তোলা, বালি-পাথর সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন তিনি। নিজ বাড়িতে পাথর বোল্ডার ও পাথর ভাঙার মেশিন নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
এরপুর্বে সোমবার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) সহকারী পরিচালক আজিজুল হক জব্দকৃত খনিজ পাথরের পরিমাণ ও নিলামের বিষয়ে বলেন, বিএমডির ম্যাজিস্ট্রেট দুইবারে ১০ হাজার ৭৪৩ ঘনফুট পাথর জব্দ করেছেন সেই পাথরই নিলাম দেয়া হবে। নিলামের সিডিউল/ দরপত্র ক্রয়ের জন্য বিকাশ/নগদ নাম্বার দেয়া হয়েছে। সিডিউল/ দরপত্র ক্রয়ের পর তাহিরপুরের ইউএনও নিশ্চিত করলে নিলাম ডাকে অনলাইন প্লাটফর্ম (জুমে) লিংক দেয়া হবে তখন নিলাম ডাকে অংশ নিতে পারবেন।
নিলাম ডাকের এন্ট্রি সময়সীমা মঙ্গলবার বেলা ৩টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা। আবার নিলাম ডাকের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে মঙ্গলবার বিকেল ৪টা। আরও অধিক পরিমাণ পাথর সিঙ্গেল বোল্ডার থাকার পরও কেন জব্দ করা হয়নি-জানতে চাইলে আজিজুল হক বিষয়টি এড়িয়ে যান।
অভিযোগ উঠেছে, অতীতের ন্যায় এই নিলামের আড়ালে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে মোতালেবচক্রকে ১১০ কোটি টাকার খনিজ বালি পাথর সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন বিএমডির কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারি জেলা, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশের কিছু অসত অফিসার।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, জাদুকাটা নদীর পুর্ব তীরে অবৈধভাবে উক্তোলনকৃত সকল বালি পাথর জব্দ করতে তাহিরপুরের ইউএনওকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ।
-১৬-০৯-২৫