“সিপাই থেকে শতকোটিপতি রাজস্ব কর্মকর্তা নয়ন”: গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির নতুন সাম্রাজ্য

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত গ্রাম বাংলার খবর জাতীয় ঢাকা প্রশাসনিক সংবাদ বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

মোঃ সারওয়ার হোসেন নয়ন।


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ কাস্টমসের গণ্ডি পেরিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এক নাম— মোঃ সারওয়ার হোসেন নয়ন। এক সময়ের সাধারণ সিপাই, আজকের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা। সরকারি বেতনের হিসাব মেলাতে গিয়ে যিনি হিমশিম খেয়েছেন— সেই নয়নের এখন নামে-বেনামে শত কোটি টাকার সম্পদ! যেন বাস্তবের “মির্জা মাল্টিপ্লায়ার”— যত বছর চাকরি, তার চেয়েও দ্রুত গুণিতক হারে বেড়েছে তার সম্পদ!

সিপাই থেকে সোনা ব্যবসায়ী, সোনা থেকে “সোনা ভাই” : দুদকের নথি বলছে, নয়ন তার চাকরি শুরু করেন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একেবারে নিচের পদে— সিপাই হিসেবে, স্বৈরাচারী আমলে।


বিজ্ঞাপন

কিন্তু দায়িত্ব পেয়ে গেলেন বিমানবন্দরে— সোনার খনি!
সেখানেই শুরু হয় তার স্বর্ণ ও বিদেশি পণ্য চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে সখ্য। একসময় “কাস্টমসের লোক” থেকে হয়ে যান “কাস্টমসের ভিতরের লোক”।
চোরাচালানকারীরা ডাকেন “সোনা ভাই”, আবার অফিসে সবাই জানে “নয়ন সাহেব” নামে।


বিজ্ঞাপন

জমি, ব্যাংক, বিল্ডিং — নয়নের সাম্রাজ্য : নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার ছোট্ট গ্রাম মনিয়ারী— সেখানেই গড়ে উঠেছে নয়নের “রাজ্য”। নওগাঁ থেকে  তথ্য অনুযায়ী, তার নামে ও বেনামে জমি রয়েছে প্রায় ১২০ বিঘা। এলাকাভেদে দাম ধরলে শুধু এই জমিতেই কয়েক কোটি টাকার মালিক তিনি।

মৌজাভিত্তিক সম্পদের তালিকা : ( ১)  দমদত্তবাড়িয়া – ৪৫ বিঘা, (২️) হিঙ্গুলকান্দি – ১৫ বিঘা, (৩️) বাহাদুরপুর – ১৮ বিঘা, (৪️) তেজনন্দী – ২৫ বিঘা এবং  (৫️) লালপাড়া – ১৭ বিঘা।গ্রামবাসী বলছে, তার কৌশল ছিল সহজ— “এক লক্ষ টাকা দিয়ে দলিল আটকে রাখো, পাঁচটা ফাঁকা স্ট্যাম্পে সই নাও, আর একটা ব্যাংক চেক জিম্মি করো।”তারপর ? চুপচাপ দলিল নামজারি, জমি নিজের নামে— আর কৃষকরা হয়ে গেলেন মাটিহারা!

ব্যাংক লেনদেনে কোটি কোটি টাকা : আত্রাইয়ের সমসপাড়া বাজারের কৃষি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে প্রতিদিনই “নয়ন সাহেবের” নামে জমা পড়ে লাখ লাখ টাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তারাও এখন বলেন, “নয়ন সাহেব না এলে আমাদের দিনের জমা অসম্পূর্ণ থাকে!”

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, তার টাকার স্রোতে গ্রামের অর্থনীতি এখন কৃত্রিমভাবে ফুলে উঠেছে— কিন্তু কৃষকদের ঘর ফাঁকা।

নয়ন বাহিনী” ভয় আর প্রভাবের জোড়াতালি : নয়ন শুধু দুর্নীতিতে নয়, প্রভাব খাটাতেও অতুলনীয়। স্থানীয়রা এখন তাকে চেনে “নয়ন বাহিনী”-এর অধিনায়ক হিসেবে। এই বাহিনীর মূল কাজ— ভয় দেখানো, জমি দখল, আর বিরোধীদের চুপ রাখা।

এক প্রবীণ গ্রামবাসী বলেন,“সে এলেই গ্রাম নিঃশব্দ হয়ে যায়। সবাই দরজা বন্ধ করে।”

বেতনে ফ্ল্যাট, চাকরিতে টাওয়ার : ঢাকায় নয়নের বিলাসী জীবনযাপন এখন কাস্টমস দফতরের “চায়ের টেবিল টপিক”।বাড়ি-বাড়ি গাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি— সবই সরকারি বেতনের সীমা ছাড়িয়ে যায় বহুদূর।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে যেভাবে দুর্নীতি রীতিতে পরিণত হয়েছে— নয়ন যেন তার জীবন্ত উদাহরণ।

এক সময়ের “লালদার অফিসার”রা এখন “গোল্ডেন চেইন সিন্ডিকেট” চালাচ্ছেন, কেউ বন্ড সুবিধায় কোটি টাকা ফাঁকি দিচ্ছেন,কেউ আবার আমদানি-রপ্তানির অজুহাতে ব্যাংকে পাচ্ছেন অজানা উৎসের টাকা। নয়নের কাহিনি সেই মহাদুর্নীতির চেইনেরই এক গাঢ় রূপ।

দুদকের নড়াচড়া: “প্রমাণ মিলেছে, ব্যবস্থা আসছে” : দুদক সূত্রে জানা গেছে, নয়নের আয়-ব্যয়ের হিসাবের অসামঞ্জস্যতা স্পষ্ট। জমি, ফ্ল্যাট, ব্যাংক লেনদেন— সব কিছুর কাগজ মিলিয়ে দেখা গেছে বিপুল অবৈধ সম্পদের প্রমাণ।

দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ,“নয়নের বিরুদ্ধে মামলার মতো পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে। তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ : আইন বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট কামরুল আলম বলেন, “সরকারি চাকরির বেতনে শত কোটি টাকার সম্পদ মানে শুধু দুর্নীতি নয়— প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন।”

সামাজিক বিশ্লেষক ড. সাইফুল হক যোগ করেন,  “গ্রামীণ কৃষিজমি এখন প্রভাবশালীদের হাতিয়ার। নয়নের মতোদের লাগাম টানতে জনগণের ঐক্য দরকার।”

যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ : নয়নকে তার মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উপসংহার : দুর্নীতির পায়ের নিচে মাটি ফেটে যাচ্ছে, সারওয়ার হোসেন নয়নের গল্প কেবল একজন কর্মকর্তার নয়—
এটা বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।
সাধারণ সিপাই থেকে কোটি টাকার মালিক— এই পথের প্রতিটি ধাপেই লুকিয়ে আছে চোরাচালান, জমি দখল, ভয়-ভীতি আর প্রশাসনিক নীরবতা।

যতদিন না দুদক, কাস্টমস প্রশাসন ও জনগণ একসঙ্গে দাঁড়ায়—ততদিন নয়নের মতো “রাজস্ব সাম্রাজ্যের রাজারা” থেকে যাবে অপ্রতিরোধ্য।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *