রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মো. সাহেদের উত্থান যেভাবে

অপরাধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার কে এই সাহেদ? কি তার পরিচয়? কি তার পেশা? কি তার নেশা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেড়িয়ে আসছে। তিনি কখনো অবসরপ্রাপ্ত মেজর, কখনো সচিব পরিচয় দিতেন। শুধু কি তাই প্রতারক সাহেদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক প্রধানেরও পরিচয় দিতেন।
জানা গেছে, প্রতারক এই সাহেদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। অত্যান্ত নিম্নবৃত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও প্রতারণার মাধ্যমে অল্পদিনেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার এই উত্থানে গ্রামের মানুষ হতবাগ। তার একাধিক নাম রয়েছে তিনি কখনো কখনো মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্ণেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কখনো মেজর শাহেদ করিম হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু তার আসল নাম জাতীয় পরিচয় পত্রে শাহেদ করিম লেখা। কিন্তু বর্তমানে তিনি মো. সাহেদ নামে আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে। যার নম্বর হলঃ ২৬৯২৬১৮১৪৫৮৮৫ আর এ জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয় ২৫-৮-২০০৮ইং।
ভ্ক্তুভোগিরা জানান, প্রতারণাই তার পেশা, আর এই প্রতারণার মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়াই তার নেশা। প্রতারণা আর চাপাবাজির মাধ্যমেই তার উত্থান হয়েছিল। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রায় দুই ডজন মামলা রয়েছে। কিন্তু তার পরও নাগালও পায়নি কেউ। কারণ তিনি নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টক শো’তে অংশ নেওয়াও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই মিডিয়ার দোহাই দিয়েও শেষরক্ষা হচ্ছে না, রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার রিজেন্ট হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রতারক সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বুধবার র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম জানিয়েছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল ও তার মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তারা বেশ কয়েকদিন ধরে গোয়েন্দা নজরদারি করে। সেখানে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে তারা জালিয়াতি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। রিজেন্টের মালিকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হয়।
ভুক্তভোগিরা জানান, সাহেদ ২০১০ সালের দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দেন। পরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় নিয়মিত মামলা করেন। এরপর গত ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল। কিন্তু প্রতারণার সেই টাকার বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হন। এরপর প্রতারণার টাকা দিয়ে রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় রিজেন্ট হাসপাতাল গড়ে তোলেন।
সূত্র জানায়, প্রতারক সাহেদ এবার ভিন্ন কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি দফতরে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। আর এই সব প্রতারণার পরিচয় কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। যাতে সবাই বুঝতে পারে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চলাফেরা রয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট মালিক সাহেদ বিভিন্ন অপকর্ম করছেন। এ বিষয়ে কেউ কিছু বললেই দেখে নেওয়ার হুমকি দিতেন।
শুধু কি তাই, গত কয়েক বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। অবৈধ অর্থ ব্যায় করে বিভিন্ন টক শো’তে অংশ নেওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেড়িয়ে আসছে। টক শো’তে বিরোধী রাজনীতিকদের বিষয়ে বেশি বেশি সমালোচনা করা সাহেদের বিরুদ্ধে একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার ঘনিষ্টজনরা বলেছেন। আবার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকাও খুলেছেন। নিজেকে সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচয় দেন। আর অপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচানোর ওই পরিচয়টি ব্যবহার করতেন।
অপর সূত্র জানায়, বিএনপি সরকারের আমলে রাজাকার মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাথে সর্ম্পক গড়ে তাদের মাধ্যমে তারেক জিয়ার হাওয়া ভবনের অন্যতম কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন এই সাহেদ। শুধু কি তাই, ১/১১ ফকরুদ্দিন সরকারের সময় আর খাম্বা মামুনের সাথে সে ২ বছর জেলও খাটে। জেল থেকে বের হয়ে শাহেদ ২০১১ সালে ধানমন্ডির ১৫ নং রোডে এমএলএম কোম্পানী বিডিএস ক্লিক ওয়ান নাম বাটপারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। তখন তার নাম পরিচয় দিতেন মেজর ইফতেখার করিম চৌধুরী।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তারা প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন।এসব মামলার অধিকাংশই প্রতারণার মামলা। প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার নেশা। এজন্য করোনা মহামারি চলাকালেও স্পর্শকাতর একটি বিষয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে বিবেকে বাধেনি তার। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। মামলা নম্বর-৫। উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা জানান, প্রতারণা ও অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন হাসপাতালের অ্যাডমিন আহসান হাবীব (৪৫), এক্সওে টেকনিশিয়ান হাসান (৪৯), মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট হাকিম আলী (২৫), রিসিপশনিস্ট কামরুল ইসলাম (৩৫), রিজেন্ট গ্রুপের প্রজেক্ট অ্যাডমিন রাকিবুল ইসলাম (৩৯), রিজেন্ট গ্রুপের এইচআর অ্যাডমিন অমিত অনিক (৩৩), গাড়িচালক আব্দুস সালাম (২৫), এক্সিকিউটিভ অফিসার আব্দুর রশীদ খান জুয়েল (২৮), প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. সাহেদ (৪৩), ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজ (৪০), হাসপাতাল কর্মচারী তরিকুল ইসলাম (৩৩), স্টাফ আব্দুর রশিদ খান (২৯), স্টাফ শিমুল পারভেজ (২৫), কর্মচারী দীপায়ন বসু (৩২) এবং মাহবুব (৩৮)সহ ১৭ জন। এদের মধ্যে ৮জনকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে।
রিজেন্ট হাসপাতালের ৮ আসামির ৭ জনের রিমান্ড মঞ্জুর : করোনা টেস্ট না করেই ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি, কোভিট রোগীরদের থেকে বিপুল অর্থ আদায়সহ নানা অভিযোগের মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপকসহ ৮ আসামির ৭ জনকে ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। অপর ১ আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক।
বুধবার দুপুরে শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে, উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রত্যেকের ৭ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল।
তবে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে রিমান্ড শুনানিকালে তাদের আদালতের এজলাসে তোলা হয়নি। এর কয়েক ঘণ্টা আগে তাদের আদালতের হাজতখানায় হাজির করা হয়।


বিজ্ঞাপন