জাল এনআইডি
নিজস্ব প্রতিবেদক : জাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সহায়তা করে আসছিলো একটি চক্র। নির্বাচন কমিশনের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ঋণ পেতে সহায়তা করতেন চক্রের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাল এনআইডি তৈরি করে ঋণ উত্তোলন করেছেন বা ঋণের আবেদন করেছেন এমন অন্তত আরো ৩০টি এনআইডির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এদিকে, জাল এনআইডিতে ঋণ নিয়েছেন এমন কয়েকজনকে শনাক্ত ও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ঋণপ্রাপ্তিতে সহায়তাকারী ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও তালিকা করা হয়েছে।
ডিবি সূত্র জানায়, ব্যাংক ঋণ পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) প্রতিবেদন প্রয়োজন হয়। জাল এনআইডির বিপরীতে ঋণ নেওয়া ও ঋণের জন্য আবেদন করেছেন এমন ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গত ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি প্রতিবেদন পেতে ডিবির পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। সিআইবি প্রতিবেদন পেলে কোন ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা কীভাবে ঋণ দিয়েছেন তা উঠে আসবে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মিরপুর চিড়িয়াখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনে সহায়তাকারী প্রতারকচক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিম। এ সময় তাদের কাছ থেকে দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট ১২টি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার সুমন পারভেজ (৪০) ও মো. মজিদ (৪২) চক্রের অন্যতম প্রধান সদস্য। অন্য গ্রেফতাররা হলেন— নির্বাচন কমিশনের সবুজবাগ এলাকার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর (৩২), গুলশান এলাকার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আনোয়ারুল ইসলাম (২৬) এবং একাধিক ব্যাংকে চাকরি করা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪১)।
এদের মধ্যে মজিদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর, আনোয়ারুল ইসলাম ও সুমন পারভেজকে আরও দুই দিনের রিমান্ড শেষে সোপর্দ করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সবশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি জাল এনআইডিসহ রাজধানীর দারুসসালাম থেকে মহিউদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, একটি জাল এনআইডি ব্যবহারে তিনি একটি ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা ঋণ উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন উপায়ে জাল এনআইডির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনের কাজ করতেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। প্রথমে তারা ঋণ পেতে আগ্রহীদের সঙ্গে তাদের চাকরি ও ব্যবসা সংক্রান্ত পরিচিতি এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করেন। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ।
এরপর মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাল এনআইডি তৈরি করে পরে ব্যাংকেরই অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঋণ পাস করিয়ে নেওয়া হয়। সিআইবি রিপোর্ট যাদের খারাপ, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ।
ডিবি লালবাগ বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিমের সহকারী কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাস বলেন, ব্যাংকে কেউ ঋণখেলাপি হলে তাদের সিআইবি রিপোর্ট খারাপ হয়। তারা পুনরায় ব্যাংকে ঋণ আবেদন করতে পারেন না। তখন গ্রেফতার চক্রের অন্যতম সদস্য সুমন ও মজিদ ঋণ পাস করিয়ে দেবে মর্মে প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নেন।
পরবর্তী সময়ে ঋণ পাস হলে মোট ঋণের ১০ শতাংশ হারে দিতে হবে মর্মে চুক্তি করেন। চুক্তিতে একমত হলে তারা প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। পরে ঋণ পাস হলে চুক্তি অনুযায়ী ঋণের সম্পূর্ণ টাকার ১০ শতাংশ হারে আদায় করেন।
সূত্র জানায়, জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতেন নির্বাচন কমিশনে ই-জোন কোম্পানির মাধ্যমে আউট সোর্সিংয়ের নিয়োগ পাওয়া সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর ও আনোয়ারুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশনের অধীনে খিলগাঁও-সবুজবাগে সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর এবং গুলশান অফিসে আনোয়ারুল ইসলাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। এ কারণে তারা নির্বাচন কমিশন অফিসের সার্ভার ব্যবহার করে সহজেই জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতে পারতেন। এজন্য প্রত্যেকটি জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি বাবদ ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন তারা।
জাল এনআইডি তৈরির প্রক্রিয়ার বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ডাট্রা এন্ট্রি অপারেটরদের কাছে ইসির সার্ভারের একসেস দেওয়া থাকে। সেই সুযোগে নির্বাচন কমিশন অফিসের একটি ফরম পূরণ করে নিয়ে যেতেন প্রতারক মজিদ ও সুমন। সেখানে অনেক তথ্যের সঙ্গে স্বাক্ষর ও কোনো এনআইডি নেই এমন ডিকলারেশন থাকতো। সেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ওই ফর্ম যেত থানা নির্বাচন কমিশন অফিসে।
মিথ্যা তথ্যের বিষয়টি জেনেও প্রথমে ঋণ পেতে আগ্রহীদের আগের এনআইডি, বিদ্যুৎ বিল ও জন্মনিবন্ধনের কপির তথ্য দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করেন তারা। এরপর নতুন নম্বরে ভুয়া এনআইডি এন্ট্রি করে সার্ভারে আপলোড দেওয়া হতো থানা নির্বাচন অফিস থেকে।
ডিবি জানায়, নির্বাচন কমিশন এই জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ও এনআইডি শাখার আইটি এক্সপার্টরা ডিবির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এনআইডি জালিয়াতিতে থানা নির্বাচন অফিসারদের ভূমিকা জানতে ইতোমধ্যে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি পুলিশ।
এসি মধুসূদন দাস বলেন, আমরা জাল এনআইডির বিপরীতে ঋণ নিয়েছেন ও ঋণের জন্য আবেদন করেছেন এমন ব্যক্তিদের তথ্যপ্রাপ্তির জন্য সিআইবি প্রতিবেদন পেতে আদালতে আবেদন করেছি। সিআইবি প্রতিবেদন পেলে জাল এনআইডির বিপরীতে কারা কারা কী পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন এবং ঋণের জন্য আবেদন করেছেন তা স্পষ্ট হবে।