উচ্চ শিক্ষিত এক অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হওয়ার গল্প

স্বাস্থ্য

ডা. সফিক বর্মন : তার নাম ছিলো ডা. জ্ঞানেন্দ্র নাথ মজুমদার। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইত্যাদি দেশের অসংখ্য রোগীরা তাকে চিনতেন বা জানতেন ডা. জ্ঞান মজুমদার নামে।


বিজ্ঞাপন

তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার একজন নামকরা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক– ডাঃ জিতেন্দ্র নাথ মজুমদার, এবং দাদু ছিলেন প্রাচীন কলকাতার আর একজন স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক
– ডাঃ প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার।
তাই হোমিওপ্যাথি ছিল তার রক্তে।


বিজ্ঞাপন

তার জন্ম কলকাতায় ১৯০৭ সালে।

অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই বাবা, দাদুর কথা না শুনেই কৃতিত্ত্বের সাথে আই.এস. সি. পাশ করার পরে ঠিক করলেন এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়বেন। ভর্তি হলেন তখনকার কলকাতার বিখ্যাত কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে, যার বর্তমান নাম আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ। অর্জন করলেন ১৯২৯ সালে তখনকার এ্যালোপ্যাথিক মেডিকেল ডিগ্রী– এম. বি.

প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন । এই কলেজে তখন অধ্যাপক ছিলেন ভারত বিখ্যাত এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়। পরবর্তীকালে তিনি ডাঃ বিধান রায় সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন– “এত বড় মহান চিকিৎসক আমি জীবনে আর একটিও দেখিনি “।

ফিজিওলজি বা শারীরবিদ্যা ছিলো তার খুবই পছন্দের বিষয়। তাই এই বিষয়টি আরও ভালোভাবে জানতে ডাক্তারি পাশ করার পরেও আবার ভর্তি হয়েছিলেন M.Sc. ফিজিওলজিতে।

এবার লন্ডন যাত্রা।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষতার সাথে ১৯৩৭ সালে অর্জন করলেন মেডিসিনের উপর L R C P, ডিগ্রী, এবং ১৯৩৯ সালে সার্জারীর উপর F R C S ডিগ্রী । মেডিসিন এবং সার্জারীতে পৃথিবীর সবথেকে দামী এবং সম্মানকর ডিগ্রী হলো এই দুইটি। দেশে ফিরলেন বিশিষ্ট এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হয়ে।

অধ্যাপক হলেন ডাঃ বিধান রায় প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ” ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ” সার্জারি বিভাগে।

কিন্ত রক্তে যার হোমিওপ্যাথি, সে সারা জীবন কি ভাবে এ্যালোপ্যাথি প্রাকটিস করবে?

তাই বেশ কয়েক বছর এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করার পরে পুনরায় ভর্তি হলেন হোমিওপ্যাথিক কলেজের সান্ধ্য বিভাগে —বাপ , ঠাকুরদাদার চিকিৎসা পদ্ধতি হোমিওপ্যাথিতে কি অাছে তা একবার দেখতে হবে বলে।
১৯৫০ সালে অর্জন করলেন হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী — ডি. এম. এস.,

আরম্ভ করলেন হোমিওপ্যাথিক প্রাকটিস এবং শীঘ্রই একজন বড় মাপের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসাবে নাম করতে থাকলেন ।

রোগীর চোখ,মুখ,চেহারা, চালচলন, হাবভাব, কথা বলার ভঙ্গী —— এসব দেখামাত্র তার বেশীরভাগ প্রেসক্রিপশন হয়ে যেতো, চিকিৎসা বিজ্ঞানে যেগুলিকে বলা হয়—-Physiognomy, বা Phrenological character, অর্থাৎ External appearance দিয়ে রোগী চেনা।

১৯৭৩ সালে পঃ বঃ হোমিওপ্যাথিক কাউন্সিল তাকে সাম্মানিক –” এম. ডি. ” ডিগ্রী দিয়ে সংবর্ধনা জানান।

পৃথিবীতে এই প্রথম এত বড় একজন উচ্চশিক্ষিত এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিক প্রাকটিসনার্স হলেন।

এরপর শুধু ইতিহাস।

★ দাদু ডাঃ প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের নামে কলকাতার নারকেলডাঙ্গায় স্থাপিত করলেন একটি হোমিওপ্যাথিক কলেজ।

★ সরকারের হোমিওপ্যাথিক অ্যাডভাইজারি বোর্ডের সদস্য হলেন।

★ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একবার M L A হলেন।

আর চিকিৎসক হিসাবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো দূর দূরান্তে। ভারত ছাড়া বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকেও তার কাছে রোগী আসার ঢেউ চলতেই থাকলো।

তিনি বলতেন, ” মানব সেবার চেয়ে আর কোন বড় মহৎ কাজ এজগতে নেই, জীবনের কাছ থেকে এই শিক্ষা অামি গ্রহণ করেছি “।

১৯৫৩ সালে শ্রী যোগেশ চন্দ্র গুপ্ত কে সাথে নিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, তার পুরানো মেডিকেল কলেজের মাস্টার মশাই– ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়কে হোমিওপ্যাথিক বিল পাস করানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে ডাক্তার রায়ের খুব একটা বিশ্বাস ছিল না, তাই তিনি আজ, কাল, সামনের বছর, ইত্যাদি, করে সমানে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন ব্যাপারটা। অবশেষে ডাঃ রায় বিল উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন একটি শর্তে—– অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, গাইনি, প্রাকটিস অফ মেডিসিন, ইত্যাদি—– প্রতিটি সাবজেক্ট এ্যালোপ্যাথিক মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়তে হবে। কারন তার ধারনা হয়েছিলো— ঐ সব বিষয়গুলি হোমিওপ্যাথি কলেজগুলিতে ভালভাবে পড়ানো হয় না। কিন্তু ডাঃ জ্ঞান মজুমদার —-ডাঃ বিধান রায়ের এই প্রস্তাবে সহমত পোষণ করেননি। তিনি বরাবর হোমিওপ্যাথি এবং এলোপ্যাথির মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।

এমনকি,নিজে একজন পন্ডিত এ্যালোপ্যাথ হলেও হোমিওপ্যাথিক কলেজগুলিতে তিনি এ্যালোপ্যাথিক অধ্যাপকদেরকে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট দেওয়ার ব্যাপারে তীব্র বিরোধী ছিলেন। এ ব্যাপারে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ১৯৭৬ সালে পশ্চিমবজ্ঞে হোমিওপ্যাথি টেকওভার করেন, তখন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে তিনি লিখেছিলেন—-” ——Senior qualified homoeopaths will be the incharge of their hospital, converted homoeopaths with allopathic qualifications should strictly be avoided —-“।

এমন কি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী কোর্স করার বিপক্ষে ছিলেন, কারণ তারা আশঙ্কা ছিলো বেশী চাকচিক্য দেখাতে যেয়ে শেষে বিদেশের মতন হোমিওপ্যাথি এদেশেও নষ্ট না হয়ে যায়।

তার একটি লেখায় আমরা তাই দেখতে পাই, তিনি লিখেছিলেন —-” I want to see homoeopathy in its proper form than the glamours of University, which has spoiled homoeopathy in other parts of the world “.

মাত্র 71 বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৮ সালের ২৯শে নভেম্বর এই মহান চিকিৎসকের জীবনাবসান ঘটে।

 

পরিশেষে বলি—-

M.Sc, (CU) ,
M. B., (CU),
F R C S, (London),
L R C P, (London), —

যথেষ্ট পড়াশুনা করে উপরের অথেনটিক ডিগ্রীগুলি অর্জন করা ব্যক্তি যদি হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে সারা জীবন হোমিওপ্যাথি চর্চা করে অসংখ্য জটিল ও দূরারোগ্য র