রাজধানীর মান্ডায় কিশোর খুন
ঘটছে একের পর এক অপরাধ
তরুনদের আচরণে নির্বাক অভিভাবকরা
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীতে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে খুনাখুনির খেলায় মেতে উঠছে উঠতী বয়সী তরুণরা। কে বড়, কে ছোট এই তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে প্রায় ঘটছে খুনাখুনির ঘটনা। এমনকি বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন নামে গ্রুপ খুলে প্রভাব বিস্তার করছে কিশোর-তরুণরা। আর এসবই চলছে ওইসব এলাকার রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছত্রছায়ায়। যার পরিণতিতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে ছোটদের। গত বছরে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রায় ১০ জন কিশোরকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
এদিকে, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে রাজধানীর মান্ডায় এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে মান্ডা লেটকা ফকির শাহালমের গলিতে এ ঘটনা ঘটে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে তাকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। নিহত কিশোরের নাম মোহাম্মদ হাসান (১৬)। সে মুগদার একটি ছাপাখানায় কাজ করত। এ ঘটনায় বেলাল হোসেন নামে এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে এ হত্যাকা- ঘটে। হামলাকারীরা সিনিয়র এবং ব্যান্ডেজ গ্রুপের সদস্য। আটক বেলালও ব্যান্ডেজ গ্রুপের সদস্য। মুগদা থানা পুলিশ জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাসা থেকে হাসানকে স্থানীয় কয়েকজন কিশোর শাহালমের গলিতে ডেকে নিয়ে যায়।
একপর্যায়ে তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হলে তারা হাসানকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। হাসানের পেটে ও গলায় গুরুতর জখম হয়। স্বজনদের সঙ্গে হামলাকারী এক তরুণ রক্তাক্ত অবস্থায় হাসানকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসান পরিবারের সঙ্গে মান্ডার ওই এলাকায় থাকত। তার বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার থানার বারারা গ্রামে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয় ছিল।
হাসানের ভাই হাবীব অভিযোগ করে বলেন, মান্ডা এলাকার ব্যান্ডেজ গ্রুপের কয়েকজন কিশোর হাসানকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। খবর পেয়ে হাসানকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। কী কারণে কেন হাসানকে হত্যা করা হয়েছে তা তিনি জানেন না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ বক্সের পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া খুনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে বিরাজমান অস্থিরতা বিভিন্ন দিক বেড়ে যাওয়ায় কিশোর-তরুণদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। আর দ্বন্দ্ব থেকেই খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব খুনের হ্রাস টেনে ধরতে পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি অপরিসীম। পুরান ঢাকার ইসলামবাগ আইডিয়াল স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র মো. হাসান (১৬)। দুই বোন এক ভাইর মধ্যে সে মেজ। ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী বাবা মো. আলীর স্বপ্ন ছিল ছেলেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলবেন। একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় সবার আদরের ছিল হাসান। সদা শান্ত-শিষ্ট প্রকৃতির এই কিশোরের চলাফেরা ও ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ। কিন্তু একজন বখাটের ছুরি কেঁড়ে নিল তার প্রাণ।
নিহতের বন্ধু, পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েকদিন আগ থেকেই স্থানীয় জুনিয়র আলীর সাথে হাসানের সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব চলছিল। রাতে চকবাজার চাঁদনীঘাট এলাকার শিশু হাসপাতালের গলিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো হাসান। কিছুক্ষণ পর ওই স্থানে যায় জুনিয়র আলী। সে হাসানকে তার নাম সম্বোধন করে কাছে ডাকে। সিনিয়র হওয়ায় তা মেনে নিতে পারেনি হাসান। বিষয়টি নিয়ে আলীর সঙ্গে তার তর্ক হয়। বাগবিতান্ডের একপর্যায়ে আলী হাসানের পেটে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করালে শনিবার ভোররাতে সে মারা যায়। এঘটনায় জড়িত আলীকে গত রোববার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে শুধু হাসান-ই নয়; চলতি বছরে এরুপ দ্বন্দ্বে নয়জন সহপাঠী ও বন্ধুদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছে।
জানা যায়, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে খেলার মাঠে ঝগড়ার পর গত ৬ অক্টোবর কদমতলীর রায়েরবাগের মুজাহিদনগর এলাকায় গ্রিল মিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম শিপনকে (১৮) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার বন্ধুরা। নামাজ পড়তে ডাকা নিয়ে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জের ধরে গত ১৩ আগস্ট রাতে মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র মোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জের ধরে গত ২২ আগস্ট মিরপুরের উত্তর পীরেরবাগ এলাকায় খুন হন কবির হোসেন (২১) নামে আরেক তরুণ। এ ঘটনার তিন দিন পর অর্থাৎ ২৫ আগস্ট দারুসসালামের টোলারবাগে একই দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাত করে শাহিনকে (১৬) খুন করা হয় বলে অভিযোগ তার মা সালেহা বেগমের।
গত বছরের ১ জুলাই চা পান করতে গিয়ে কে বড়, কে ছোট এই নিয়ে বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে আদাবরের শেখেরটেক এলাকায় সজল (১৫) নামে এক টেইলার্স কর্মীকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে তার বন্ধুরা। বছরের শুরুতেই (৬ জানুয়ারি) গ্রুপ ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির (১৫)। এ ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে রূপনগরে হত্যার শিকার হয় কিশোর কামাল হোসেন। ১৮ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় খুন হয় আবদুল আজিজ (১৮) নামে এক তরুণ। এর আগে ৯ তারিখে ক্যান্টিনে বসা নিয়ে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে সেন্ট্রাল রোডে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হন বাণিজ্য বিভাগের একাদশ শ্রেণির ছাত্র নাইমুর রশিদ নাবিল (১৮)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, সমাজের অস্থিরতা ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে খুনের ঘটনা ঘটছে। যেহেতু এগুলো লোকাল ইস্যু সেহেতু এর হ্রাস কমাতে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিংয়ের কর্মতৎপরতা বাড়াতে হবে। একই সাথে পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানদের প্রতি দৃষ্টি রাখলে ও তাদের মনিটরিং করলে এসব কমে আসবে। তার মতে, এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিনিয়র-জুনিয়রদের দ্বন্দ্বটি বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে। এর মধ্যে একই এলাকায় সমবয়সী কাউকে আধিপত্য বিস্তার করতে দেখলেই আরেকজন বা আরেক গ্রুপ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এলাকায় পার্টি করা, হর্ণ বাজিয়ে প্রচ- গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে নিজেকে/নিজেদের অবস্থান জানান দিতে উঠে পড়ে লাগে কেউ কেউ। এ থেকেই গ্রুপ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িত পড়ে। এদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। বছরের শুরুতে খুন হওয়া আদনান কবিরের বাবা কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় যে মামলা করেছেন, তাতেও ছেলের খুনের কারণ হিসেবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গ্রুপিংয়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে গত বছর মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, গ্রুপ কিংবা সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে যে কটি খুনের ঘটনা ঘটেছে ওইসব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েকটি ঘটনার পর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের অংশ হিসেবে আমরা (পুলিশ) স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছি। সচেতন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন গ্রুপ বা নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্বের পরিণতি সম্পর্কে বুঝানো হয়েছে। এসব নিরুপনে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ তথা শিক্ষক, অভিভাবকদেরও উচিত কিশোর-তরুণদের বুঝানো। তার মতে এসব করে লাভ নেই যদি না কিশোরদের সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা না যায়।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, কিশোররা পাড়া-মহল্লায় গ্রুপ কিংবা গ্যাং তৈরি করলেও রাজনৈতিকভাবে তাদের আশ্রয় নেই। নিজেদের যাতে এলাকাবাসী সমীয় করে এই কারণেই গ্যাং/গ্রুপ খোলা। তবুও যারা গ্রুপে জড়িত ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে লিপ্ত তাদের অনুপ্রাণিত করে, বুঝিয়ে স্বাভাবিক অবস্থানে নিয়ে আসতে কাজ করছি। সামাজিকভাবেও তাদের দমিয়ে রাখার প্রক্রিয়াও নিয়েছি। তাছাড়া থানা পুলিশকে পাড়া-মহল্লায় নজরদারি জোরদার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বলা আছে। আর এ ধরনের ঘটনা ঘটার আগে পুলিশ বিষয়টি জানতে পারলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে ২০২০ সালের ১২ আগস্ট মাদারীপুরে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসময় আহত হয়েছেন অন্তত ৮জন। মাদারীপুর পৌরসভার পাকদী এলাকায় ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাতে পাকদী এলাকার তুষার সরদারের সাথে পাশের থানতলী এলাকার মিঠুন খলিফার সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে কথার কাটাকাটি হয়। পরে দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। এ খবরে পরে দু’পক্ষের সমর্থকরা দেশিয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসময় অর্ধশত ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাংচুর ও লুটপাট হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৮জন। আহতদের উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি পাঠানো হয়েছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। এসময় দুইজনকে আটক করা হয়।