মুনিয়ার গলায় ক্ষতচিহ্ন, নিম্নাঙ্গ রক্তাক্ত ছিল সুরৎহাল রিপোর্টে
নিজস্ব প্রতিবেদক : বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভির গোয়েন্দা নজরদারিতে। যে কোন সময় তাকে আটক করা হতে পারে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে।
গুলশানে লাখ টাকায় ফ্ল্যাটভাড়ায় কলেজছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভনে ভোগ করা ও আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার একমাত্র আসামি সায়েম সোবহান আনভীর।
এর আগে ওই তরুণীকে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে করা মামলার আসামি সায়েম সোবহান আনভিরের বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. শহিদুল ইসলামের আদালত এ নিষেধাজ্ঞা দেন।
অপরদিকে গুলশানে লাখ টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাট উদ্ধারকৃত মুনিয়ার লাশের গলায় ক্ষতচিহ্ন, যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত ছিল বলে সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তারা গুলশানের ওই ভবনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে। অপরদিকে মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান অভিযোগ করে বলছেন, তাকে মুঠোফোনের মাধ্যমে নানা ধরণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, তার বোনকে বিয়ের কথা বলে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন আনভীর। একটি ছবি ফেসবুকে দেওয়াকে কেন্দ্র করে সায়েম সোবহান তার বোনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। মুনিয়াকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তবে মুনিয়ার নিহতের ঘটনাটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা, সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না বলে জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। মরদেহের সুরতাহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, গলার বাম পাশে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির গভীর কালো দাগ আছে। যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্ত বের হওয়ার আলামত মিলেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের আগাম জামিনের জন্য বুধবার উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিধি ও চলমান সর্বাত্মক লকডাউনে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে এ মুহূর্তে কোনো ধরণের আগাম জামিন শোনা যাবে না বলে গতকাল অভিমত জানিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ অভিমত প্রকাশ করেন। বেঞ্চটির বৃহস্পতিবারের কার্যতালিকায় মোসারাত জাহান ওরফে মুনিয়াকে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে করা মামলার আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের আগাম জামিন আবেদনটি ১৪ নম্বর ক্রমিকে ছিল। বেলা পৌনে ১১টার দিকে কার্যক্রম শুরু হলে আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনাদের আরজির কারণে আমরা গতকাল বলেছিলাম, কিছু আগাম জামিন আবেদন শুনব। তবে কবে শুনব বলিনি। সুপ্রিম কোর্টের বিধি ও বর্তমান সর্বাত্মক লকডাউনে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে এ মুহূর্তে কোনো ধরণের আগাম জামিন শোনা যাবে না। ১৩ থেকে ২৭ পর্যন্ত আইটেম (আগাম জামিনের আবেদন) ভুলভাবে এসেছে। নির্দেশনা ছিল ভবিষ্যতে আসবে কিন্তু আজ ভুলক্রমে এসেছে। সুতরাং আগাম জামিন আবেদনের শুনানি হবে না।’
এর আগে ২৬ এপ্রিল রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাতের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তার বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। এ মামলার একমাত্র আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। চাঞ্চল্যকর এই আত্মহত্যার ঘটনার মামলা নিয়ে এখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। মামলার বাদিসহ অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, ঘটনার মামলাটি নারী নির্যাতনের মামলার ধারায় হতে পারতো।
গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার নিয়ে রহস্য বেড়েই চলছে। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এটি আত্মহত্যা নাকি হত্যা সেই প্রশ্ন উঠেছে। পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, মুনিয়াকে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য সিলিং ফ্যানের সঙ্গে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ছাড়াও পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করছেন। বাসা থেকে ফুটপ্রিন্টসহ সব ধরণের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। মুনিয়া আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, বিষয়টি ক্লিয়ার হতে কিছু সময় লাগবে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা সবগুলো বিষয় সামনে রেখেই তদন্ত করছি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে অনেক কিছুই ক্লিয়ার হবে। এছাড়া ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ, ভিসেরা পরীক্ষাসহ সবকিছুই করা হচ্ছে। আত্মহত্যা করে থাকলে মেয়েটি কেন আত্মহত্যা করলো তার কারণও জানার চেষ্টা চলছে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মুনিয়া যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতো সেই অ্যাপার্টমেন্টের সব সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। এগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে। মুনিয়ার ফ্ল্যাট থেকে সর্বশেষ কে বের হয়েছে কিংবা ঘটনার দিন ওই বাসায় কারা গিয়েছিল বা বের হয়েছে তা যাচাই করা হচ্ছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করতে কিছু সময় প্রয়োজন। এছাড়া মুনিয়া ও সন্দেহভাজনদের কল রেকর্ডও পরীক্ষা করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন সায়েম সোবহান ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন তা জানার চেষ্টা চলছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এখানে হুটহাট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। তা না হলে আসামি মামলা থেকে স্কিপ করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এজন্য ফরেনসিক পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুনিয়ার মোবাইল ফোনসহ অনেক কিছুই ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে। মুনিয়ার ডায়েরির লেখাগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, মুনিয়া এর আগে বনানীসহ মিরপুরের একটি ফ্ল্যাটে থাকতো বলে তারা জানতে পেরেছেন। মিরপুরের ওই ফ্ল্যাটেও সায়েম সোবহান নিয়মিত যাতায়াত করতেন বলে জানা গেছে। ওই ভবনের মালিক এস আলম গণমাধ্যমে বলেছেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে মুনিয়া আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতো। সে সময় আমি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে পাজেরো গাড়ি নিয়ে আসতে দেখেছি। আমি মুনিয়াকে জিজ্ঞাসা করলে তার স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছিল। এখন তো দেখি অন্য বিষয়।’
অপর সূত্র জানিয়েছে, মুনিয়ার মৃত্যু রহস্যের সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রামের এক হুইপের ছেলের সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানের মেয়ে ঘটিত বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। এছাড়া ৫০ লাখ টাকা পাওয়া নিয়ে সায়েম সোবহান ও মুনিয়ার একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। এসব বিষয়েও আমরা অনুসন্ধান করছে পুলিশ। তদন্ত শেষে বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলার বাদি গতকাল সন্ধ্যা বলেন, সায়েম সোবহানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল মুনিয়ার। প্রতিমাসে এক লাখ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে সায়েম সোবহান তাকে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিল। নিয়মিত ওই বাসায় সায়েম যাতায়াত করতো। তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো করে থাকতো। মুনিয়ার বোন অভিযোগ করেছেন, তার বোনকে বিয়ের কথা বলে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিল। একটি ছবি ফেসবুকে দেওয়াকে কেন্দ্র করে সায়েম সোবহান তার বোনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তাদের মনে হচ্ছে, মুনিয়া আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এর বিচার চান তারা।
মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান জানান, তার বোন মিরপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঢাকায় থাকাকালেই আনভীরের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রায়ই ফোনে কথা হতো। দেখা হতো বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। ২০১৯ সালে স্ত্রী পরিচয়ে বনানীর একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মুনিয়াকে নিয়ে থাকতেন আনভীর। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনভীরের পরিবার বিষয়টি জানতে পারে। ওই সময় ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে দিয়ে মুনিয়াকে নিজেদের বাসায় ডেকে নেন আনভীরের মা। বাসায় নিয়ে তাকে হুমকি-ধমকি দেন। আনভীরের সঙ্গে মেলামেশা করলে পরিণতি হবে কঠিন। শর্ত দেন বেঁচে থাকতে চাইলে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। ওই সময়ে আনভীরও তাকে কুমিল্লা চলে যেতে বলেন। ওই সময়ে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়। অবস্থা প্রতিকূল দেখে ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লা চলে যান মুনিয়া। এরমধ্যে আবার আনভীর তাকে ডাকেন। বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেন। যেহেতু তার পরিবার এটি মানছে না তাই বিয়ে করে বাইরের কোনো দেশে মুনিয়াকে সেটেল করবেন বলে জানান। এক পর্যায়ে গত ১লা মার্চ গুলশানের ওই বাসা দুই বছরের জন্য ভাড়া নেন মুনিয়া। সম্পর্ক ভালোই চলছিল তাদের। প্রায়ই ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন আনভীর। দেয়ালে ঝুলানো ছিল তাদের অন্তরঙ্গ বিভিন্ন ছবি। কিন্তু মুনিয়াকে নিয়ে বাইরে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতেন না আনভীর।
তিনি জানান, তার বোনকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ঢাকায় এনে লাখ টাকা ভাড়া বাসা রেখেছেন। তার সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। এরপর পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা অথবা আত্মহত্যায় বাধ্য করেছেন। বিয়ে না করে তার সঙ্গে মেলামেশা তো ধর্ষণের অপরাধে মামলা হতো পারতো। কিন্তু পুলিশ আত্মহত্যায় প্ররোচণার মামলা নিয়েছে। তখন আমার বোনকে ঘরে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় দেখে আর আমাদের মানসিক অবস্থা খারাপ ছিল। এছাড়া আমরা ধারা টারাও বুঝি না। তাই কোন প্রতিবাদ করতে পারি নাই।
গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী আব্দুল কুদ্দুস জানিয়েছেন, গত ২২, ২৩শে এপ্রিল পরপর দু’দিন ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন সায়েম সোবহান আনভীর। ফ্ল্যাট বি-৩ থাকতেন মুনিয়া। বাসাটি গত ১লা মার্চ দুই বছরের জন্য ভাড়া নেন মুনিয়া। মুনিয়ার নামে ভাড়ার চুক্তি থাকলেও সংশ্লিষ্টরা জানান বাড়ির মালিকের মেয়ের জামাতা ইব্রাহিমের কাছে প্রতি মাসে ভাড়া ১ লাখ ও সার্ভিস চার্জ ১১ হাজারসহ ১ লাখ ১১ হাজার টাকা অন্য কেউ পাঠাতেন।