বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানী উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল সিটি সেন্টার পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলছে। এর মধ্যে উত্তরার তৃতীয় পর্ব (দিয়াবাড়ি) থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
তবে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন বলছে, দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সময়ানুপাতিক ও সমন্বিত অগ্রগতি হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ সম্ভব নয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এ অংশে মেট্রোরেল চালু করতে তিন মাস সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের মার্চ করার প্রস্তাব করেছে আইএমইডি।
তাতে বলা হয়, কাজ দেরিতে শুরু হওয়া, কাজের গুণগত মান বজায় রাখাসহ বেশকিছু কারণে এ সময় বৃদ্ধি প্রয়োজন।
তবে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্ধারিত সময়েই (২০২০ সালের ডিসেম্বর) চালু করা সম্ভব। সার্বিক বিবেচনায় মেট্রোরেল প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) সময়ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অগ্রগতি প্রায় ১৬ শতাংশ পিছিয়ে আছে।
মেট্রোরেল প্রকল্প অগ্রগতির এ পিছিয়ে থাকা ‘দুর্বল দিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আইএমইডির ওই প্রতিবেদনে। গত মে মাসে প্রতিবেদনটি দেয় আইএমইডি।
মেট্রোরেলের মাঠপর্যায়ে কাজ শুরুর পর থেকে চলছে জনভোগান্তি। বায়ু দূষণ, যানজট সংশ্লিষ্ট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ায় এ ভোগান্তি আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ডিপিপির পরিকল্পনায় দুর্বলতা রয়েছে। দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ ১২ বছর। অথচ পরিকল্পনা, ডিজাইন ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় চার বছরের বেশি সময় লেগেছে। সেই সঙ্গে ক্রয় কার্যক্রম ও বাস্তবায়ন পর্যায়ের সময় আলাদাভাবে নির্দিষ্ট না করায় বাস্তবে প্রকল্পের ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ এবং ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে।
মেট্রোরেল শুরুর পয়েন্ট তথা উত্তরার তৃতীয় পর্ব (দিয়াবাড়ি) স্টেশনের কাছাকাছি উত্তরার দ্বিতীয় পর্ব, প্রথম পর্ব, টঙ্গী ও বিমানবন্দর সড়কের কোনো সংযোগ নেই। এছাড়া কয়েকটি ব্যস্ত ইন্টারসেকশনে সাবওয়ে নির্মাণ করা হয়নি। এত বড় প্রকল্পের এসব দিককে দুর্বল হিসেবে উল্লেখ করেছে আইএমইডি।
প্রকল্প এলাকার সড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়, এলাইনমেন্টে যানবাহন চলাচল করতে পারলেও গাড়ির গতি কম এবং দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণ রোধে গৃহীত ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সঠিক হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, সিপি-৩ ও সিপি-৪ (দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও) এলাকায় ২০১৮ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার পিএম১০ এ ও পিএম২.৫- এ সীমার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।
বাতাসে পিএম১০ এর স্বাভাবিক মাত্রার সীমা ১৫০। কিন্তু পল্লবী, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া ও আগারগাঁও-এ পিএম১০ পাওয়া গেছে যথাক্রমে ২৪৮, ২২৮, ১৬৩ ও ১৯৮। অন্যদিকে পিএম২.৫ এর স্বাভাবিক মাত্রার সীমা ৬৫। কিন্তু এসব এলাকায় তা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১০৮, ৯১, ৭২ ও ১১১।
এ ব্যাপারে মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচালক মো. আফতাবউদ্দিন তালুকদারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন চার পরামর্শক ও আইএমইডির তিন কর্মকর্তা। তাদের একজন আইএমইডির পরীবিক্ষণ ও মূল্যালয়ন সেক্টর- ২ (পরিবহন) এর পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি দাবি করেন, তিন মাস সময় বাড়ানো হলেও প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে না। হয়তো একটু বেশি সময় লাগবে কিন্তু প্রকল্পের অবস্থা ভালো। সময় বেশি লাগায় ভোগান্তি থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।
খরচ বাড়বে না বলে দাবি করলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেট্রোরেল নির্মাণের ফলে স্টেশনগুলোতে ফুটপাতের জায়গা থাকবে না। ফলে এমআরটি লাইন-৬ এর স্টেশনগুলোতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমতিক্রমে কিংবা প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ করে ফুটপাত প্রশস্তকরণের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ অংশে ডিপিপির সময়ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ১৬ শতাংশ পিছিয়ে আছে বলা হলেও প্রকল্পের দুর্বল দিক অংশে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তা ১৪ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোন তথ্যটা সঠিক- এর উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারেননি আব্দুল্লাহ আল মামুন।
রাজধানীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দেশি-বিদেশি পরিবহন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড ঢাকা মহানগরীর জন্য এসটিপি প্রণয়ন করে। এতে অন্তর্ভুক্ত এমআরটি লাইন-৬ কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণের জন্য ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) উন্নয়ন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় পাস হয়।
২০১২ সালের জুলাইয়ে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি সাত লাখ ২১ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এ প্রকল্প ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে এমআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।