নির্বাচন ঘিরে খুনোখুনি, নিহত বেশি আ’লীগে

বিশেষ প্রতিবেদন

একটি ইউনিয়নে দেখা যাবে ১০ জন নেতা আছেন যারা চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্য। সবাই চান চেয়ারম্যান হতে। কিন্তু মনোনয়নতো সবাইকে দেওয়া সম্ভব নয়। যখন একজনকে দেই, বাকিরা অভিমান করেন। কেউ বিদ্রোহ প্রার্থী হয়ে যান। কিছু নেতার ঘাড়ে বিএনপি-জামায়াত চড়ে বসে।
ফারুক খান এমপি, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের ১০ মাস ৯ দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে ৪১ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
শুধু চেয়ারম্যান প্রার্থী নয়, সদস্য প্রার্থী নিয়েও ঘটছে খুনোখুনির ঘটনা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও রেষারেষির জেরেই এসব বেশি ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনপ্রতিনিধিরা ব্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা করে নির্বাচনে জিততে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যেকোনও মূল্যে জিততে চান তারা। অতীতে ইউপি মেম্বার পদের প্রার্থীদের নিয়ে এমন প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা দেখা যেত না।
তবে এ বক্তব্যে একমত নয় আওয়ামী লীগ। দলটির এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ইউপি নির্বাচন পদ্ধতি দলীয় মনোনয়নে নতুন করে হচ্ছে বলে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। নতুন একটি বিষয় মানিয়ে নিতে সময় লাগে। আরও দুই-একটি টার্মের ভোট হলে এতে সবাই অভ্যস্থ হয়ে যাবে।’
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৪৬৯টি নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন ছয় হাজার ৪৮ জন এবং নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪১ জন, বিএনপির ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন এবং একজন সাংবাদিক মারা গেছেন।
আসকের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটেছে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এ পর্যন্ত ২৯৮টি সহিংসতার ঘটনাই ঘটেছে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে। এ ছাড়া পৌর নির্বাচনকে ঘিরে ১১টি, সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছয়টি ও বাকিগুলো অন্যান্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। এসব সহিংসতার মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষই বেশি। দলটিতে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয়েছে ৬৯ বার। এ ছাড়া অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলোও সহিংসতায় জড়িয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়েছে মাত্র ছয়বার।
সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে নভেম্বরের প্রথম ৯ দিনে। এ সময়ে ৯৫টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই ছিল ৮৮টি। এই ক’দিনের সহিংসতায় আওয়ামী লীগের সাতজন এবং চারজন সাধারণ মানুষ মারা গেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘একটি ইউনিয়নে দেখা যাবে ১০ জন নেতা আছেন যারা চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্য। সবাই চান চেয়ারম্যান হতে। কিন্তু মনোনয়নতো সবাইকে দেওয়া সম্ভব নয়। যখন একজনকে দেই, বাকিরা অভিমান করেন। কেউ বিদ্রোহ প্রার্থী হয়ে যান। কিছু নেতার ঘাড়ে বিএনপি-জামায়াত চড়ে বসে। টাকা খরচ করে বিএনপি-জামায়াত তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা সব দেখছি, তদন্ত করছি। আমাদের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশনা দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছে সেখানে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি অনুরোধ না রাখলে শোকজ করা হয়। সন্তোষজনক উত্তর না দিতে পারলে তাকে বহিষ্কারও করা হয়। আমি মনে করি, আরও কয়েকটা নির্বাচন হলে এসব সমস্যা থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘একটা ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন পদে ৭০-৮০ জন ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারা নানান বিষয় নিয়ে বিবাদে জড়ান, বাকবিত-া হয়, কখনও রক্তারক্তি কা- ঘটে। এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।’
নির্বাচনি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আসলে এখন তো দেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ কারণে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। যেহেতু নির্বাচন কমিশনার সম্পূর্ণ ব্যর্থ, প্রশাসনও অনুরূপ অবস্থানে আছে। স্বাভাবিক কারণে যেখানে আইন, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন সব একাকার সেখানে তো বিপক্ষ প্রার্থী যেকোনও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন।’
নির্বাচনি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এখন ব্যক্তির স্বার্থে রাজনীতি হচ্ছে। মনোনয়ন বা নির্বাচন হলেই লাভ। দ্রুত ধনী হওয়া যায়। পরিবার-স্বজনদের সুবিধা দেওয়া যায়। তাই রাজনীতিবিদরা মরিয়া হয়ে উঠেছে এসব পদের জন্য। তারা গ্রুপ হয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে। নির্বাচন, জনপ্রতিনিধি কোনটিই এখন মানুষের জন্য নেই।’