বিশ্বরেকর্ড
মহসীন আহমেদ স্বপন : দফায় দফায় দাম বেড়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারে এখন সব থেকে বেশি দামের পণ্যের তালিকায় সবার উপরে স্থান করে নিয়েছে পেঁয়াজ। কোনো সবজি-ই তার ধার কাছে নেই। আদা, রসুন এমনকি মাছ-মাংসেরও ওপরে চলে গেছে পেঁয়াজের দাম। শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার, রামপুরা, মালিবাগ হাজীপাড়া, খিলগাঁও, শান্তিনগর অঞ্চলের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে দেশের সব গণমাধ্যমের শিরোনামে এখন পেঁয়াজ। টিভি চ্যানেলের টকশোজুড়েও পেঁয়াজের দৌরাত্ম্য। পেঁয়াজ ঝাঁজ এখন রাজনীতির মাঠেও বিচরণ করছে। পেঁয়াজ কিনতে নাভিশ্বাস যেন দেশবাসীর। অনেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবারে ডাবল সেঞ্চুরি করেছে পেঁয়াজ। পাইকারী বিক্রেতারাই এ মসলাটি ২০০ টাকার এক পয়সা কমে বিক্রি করছেন না। যা এহাত ওহাত পেরিয়ে খুচরা বাজারে ২২০ ছাড়িয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি। শুক্রবার তা ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। বর্তমানে পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা।
শুক্রবার ছুটির দিনে অধিকাংশ চাকরিজীবী বাজার করে। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর বাজারে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দেশি পেঁয়াজের মূল্য কেজি প্রতি ৩০০ টাকা, ভারতীয় ২৫০, মিশরের পেঁয়াজ ২৪০ টাকা হিসাবে বিক্রী হচ্ছে। এটা পেয়াঁজের দামের একটি বিশ্ব রেকর্ড।
ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকেই দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির। এরপর থেকে দফায় দফায় বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সংবাদে ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ১০০ টাকায় পৌঁছায় যায় দেশি পেঁয়াজের কেজি। খুচরা পর্যায়ে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি হতে থাকে। এরপর বেশি কিছুদনি পেঁয়াজের দাম অনেকটাই স্থির ছিল। ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে নেমে এসেছিল।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর আবারও পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং আমদানি করা পেঁয়াজ আসছে না- এমন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন, ফলে আবারও ১০০ টাকায় পৌঁছে যায় পেঁয়াজের কেজি।
এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক বক্তৃতায় বলেন, পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামা সম্ভব নয়। মন্ত্রীর এই বক্তব্য পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টিকে আরও উসকে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ১০০ টাকা থেকে পেঁয়াজের কেজি ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে পরের দিন ওই পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকায় পৌঁছে যায়।
তবে এখানেই থেমে থাকেনি পেঁয়াজের দাম বাড়ার প্রবণতা। বুধবার ১৫০ টাকা থেকে পেঁয়াজের দাম এক লাফে ১৭০ টাকা হয়। বৃহস্পতিবার সেই দাম আরও বেড়ে ২০০ থেকে ২৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। আর সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার তা আরও বেড়ে ৩০০ টাকায় পৌঁছেছে। এর আগে কখনো দেশের বাজারে এত দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়নি।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন।
তিনি বলেন, পেঁয়াজের ঝাঁজ বেশি হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলে সেটি খারাপ হবে। এতে সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।
পেঁয়াজের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, এক লাফে এত টাকা বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাজারে কথা প্রচলিত রয়েছে, একই ব্যক্তি আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, মুদ্রাপাচার হচ্ছে। সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক গোয়েন্দাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
তিনি মনে করেন, এটা শুধু বাণিজ্যিক কারণ নয়; এর পেছনে অন্য কোনো ফাঁয়দা নেওয়ার অপচেষ্টা হতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম যখন কেজি প্রতি ৩০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে তখনই লন্ডনের বাজারে পেঁয়াজের খুচরা মূল্য ছিলো প্রতি কেজি বাংলাদেশি টাকায় ৫৫ টাকা করে। আবার বড় বড় গ্রোসারি শপে ২৫ কেজি পেঁয়াজের বস্তার দাম ছিলো ৮ পাউন্ড, যা কেজি দরে হিসাব করলে ৩২ পেন্স দাম হয়। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজিতে ৩৫ টাকা করে পড়ে।
ওদিকে ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানির বার্লিন শহরেও খুবই কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে। সেখানে দেখা গেছে একটি সুপার স্টোরে পাঁচ কেজি পেঁয়াজের দাম মাত্র ০.৯৯ ইউরো (বাংলাদেশি ৯২.২৫ টাকা) ধরা হয়েছে। তবে তা ৫০% ছাড়ে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় পাঁচ কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ৪৬ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ৯ টাকা ২০ পয়সা!
শীতের আগাম শাক-সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, শালগম, শিম, পালং শাক, মুলা শাক, সরিষা শাকের ভরপুর সরবরাহের মধ্যে এখন বাজারে সব থেকে বেশি দামের সবজি পাকা টমেটো। পাকা টমেটোর পাশাপাশি বাজারে দামি সবজির তালিকায় রয়েছে গাজর, শিম, বরবটি, নতুন আসা গোল আলু। এর মধ্যে নতুন গোল আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকা। শিম, গাজর ও বরবটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকার মধ্যে।
বাজারে সব থেকে ভালো মানের পাকা টমেটো বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি। আর পেঁয়াজের কেজি কোথাও ২৫০ টাকার নিচে মিলছে না। কিছু কিছু বাজারে পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা ছুঁয়েছে।
শুধু কি সবজি, বাজারে এখন সব ধরনের মুরগির থেকে পেঁয়াজের দাম বেশি। লাল কক মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা কেজি। সোনালী মুরগি পাওয়া যাচ্ছে ২২০-২৪০ টাকার মধ্যে। আর বাজার ভেদে বয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২৫ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি পেঁয়াজ দিয়ে প্রায় তিন কেজি বয়লার মুরগি কেনা সম্ভব।
বয়লার মুরগির মতো এক কেজি পেঁয়াজ দিয়ে দুই কেজি তেলাপিয়া, পাঙাস, (ছোট রুই, মিরগেল) মাছও কেনা সম্ভব। কারণ এ মাছগুলোর কেজি ১৫০ টাকার মধ্যে।
এমনকি মাঝারি সাইজের রুই মাছের দামও এখন পেঁয়াজের থেকে কম। শিং মাছও মিলছে পেঁয়াজের থেকে কম দামে। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের রুই মাছ বাজার ভেদে ২০০-২৩০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর অনেক বাজারেই শিং মাছের কেজি ২২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে পেঁয়াজের থেকে সচরাচর একটু বেশি দামেই বিক্রি হয় আদা-রসুন। এবার এ রীতিও বদলে গেছে। বাজারে এখন আদা রসুনের কেজি ২০০ টাকার নিচে।